এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের মূল্যায়নে রয়েছে একাধিক অসংগতি
আমাদের এই রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিক কাউন্সিল, উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল নির্ণয়ের জন্য যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে, একজন শিক্ষক হিসেবে সমস্ত দিক পর্যালোচনা করে মনে করছি, এমন সিদ্ধান্ত ছাত্র -ছাত্রী সহ শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এক গভীর সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। যদি বলেন কেন? তবে তাদের নিচের বিষয়গুলোর প্রতি একটু ভাববার জন্য অনুরোধ করছি।
প্রথমত, এই রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে একাদশ শ্রেণীর কোন পরীক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি কোনো ছাত্র-ছাত্রী একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় যে সাফল্য পায়, তার তুলনায় উচ্চমাধ্যমিকে অনেক ভাল ফলাফল করে। একাদশ শ্রেণীর খাতা দেখার ক্ষেত্রে কাউন্সিলের কোন নির্দিষ্ট গাইডলাইন নেই এবং স্কুল ভেদে শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেদের ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করে থাকেন। কখনো তাঁরা মনে করেন, একাদশ শ্রেণীতে সামান্য শক্তভাবে উত্তরপত্র দেখে, কোন ছাত্রছাত্রীকে আগামী দিনে আর একটু সতর্ক হতে বলা হবে। আবার ছাত্রছাত্রীরা একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হবার পর নিজেদের গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় নেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় তারা তাদের সর্বোচ্চ দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে না। অথচ সেই একাদশ শ্রেণীর পরীক্ষার নম্বরকে এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যা, ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে যাবে বলেই অনেকের অভিমত।
দ্বিতীয়ত, একাদশ শ্রেণীর যে পরীক্ষাগুলি হয়নি, সেই পরীক্ষাগুলির নম্বর কিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে? সেই বিষয়ে কাউন্সিল কিন্তু এযাবত তেমন কিছু বলছে না। একজন ছাত্র বা ছাত্রী যখন বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে, তখন তার ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি বিষয়টি ধরে নিতে হবে প্রিয় বিষয়, অথচ এই দু'টি পরীক্ষা হয়নি। ঠিক তেমনি যে ছাত্র বা ছাত্রী, জিওগ্রাফি পছন্দের সাবজেক্ট হিসেবে রেখেছিল অথবা সংস্কৃত বিষয়টি স্কোরিং সাবজেক্ট হিসেবে সে বেছে নিয়েছিল, এই বিষয়গুলি নম্বর যদি একাদশ শ্রেণীর সেই পিছিয়ে থাকা নম্বরগুলি থেকে এখন নির্ধারিত হয়, তবে সেটি ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধেই যাবে এবং তাদের বঞ্চিত করা হবে বলে মনে করছি।
তৃতীয়ত, সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে কাউন্সিল মূল্যায়নের পদ্ধতি নির্ধারণ করার পরে কিছু বিদ্যালয়কে জানাচ্ছে যে, তোমরা এখনো একাদশ শ্রেণীর নম্বর আমাদের কাছে পাঠাওনি অতএব 23 শে জুনের মধ্যে পাঠাও। এই বিদ্যালয়গুলো যেহেতু জেনে গেল যে একাদশ শ্রেণীর নম্বর উচ্চমাধ্যমিকের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব পাবে, অতএব তারা নতুন করে নিজেদের বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের স্বার্থে হয়তোবা একাদশ শ্রেণীর নম্বরের ব্যাপারে কোনো দরাজ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং এটাই স্বাভাবিক।
এবারে তাহলে প্রশ্ন উঠছে যে সমস্ত বিদ্যালয় কাউন্সিলের নির্দিষ্ট গাইডলাইন মেনে আগেই নম্বর জমা দিয়েছিল তারা কি তাহলে ভুল করল?
মূল্যায়ন পদ্ধতি ঘোষিত হওয়ার পর অজস্র অভিভাবক অভিভাবিকা বিদ্যালয়ে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ফোন করে জিজ্ঞাসা করছেন, আমাদের একাদশ শ্রেণীর নম্বর আগেই কাউন্সিলের কাছে পাঠানো হয়ে গেছে কিনা। কোন কোন বিদ্যালয়গুলি নম্বর পাঠিয়েছে এবং কোন কোন বিদ্যালয়গুলি এযাবত নম্বর পাঠায়নি, তার তালিকা কিন্তু অভিভাবক অভিভাবিকারা ঠিক জেনে গেছেন। যখন তাঁরা দেখবেন পাশের কোনো বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি নম্বর পেল, তখন কিছু কিছু বিদ্যালয় এবং সেই সকল বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকারা কিন্তু সেই অভিভাবকদের কাছে টার্গেটের জায়গায় চলে যেতে পারে। এ এক ধর্মসংকট!
কাউন্সিলের গাইডলাইন মানার ফলে এক শ্রেনীর বিদ্যালয় এবং সেই বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-শিক্ষিকারা আজ সমাজের কাছে দোষী সাব্যস্ত হতে চলেছে। এক্ষেত্রে কাউন্সিল শুরুতেই সমস্ত বিদ্যালয় থেকে একাদশ শ্রেণীর নম্বর সংগ্রহ করার পর মূল্যায়ন পদ্ধতি ঘোষণা করতে পারত।
চতুর্থত কোনো বছরের পরীক্ষার্থী শুধুমাত্র সেই বছরের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে না। তাদের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হয় বিগত দুই-এক বছর এবং সামনের দুই-এক বছরের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে। গতবছর যেখানে কোনো একটি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেলে, সেই নম্বরটিই না হওয়া পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং তাতে করে বাংলায় 98 পাওয়ার ধরুন ফিজিক্স কেমিস্ট্রি পরীক্ষা না দিয়েও অনেক ছাত্র-ছাত্রী 98 করে পেয়েছে সেখানে একদম বিপরীত চিত্র। অর্থাৎ গতবছর ছাত্র-ছাত্রীদের খুব একটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি, বরং প্রাপ্ত নম্বরের দিক থেকে অনেকেই লাভবান হয়েছে। সেখানে এবছর মাধ্যমিকের প্রাপ্ত নম্বর এবং একাদশ শ্রেণীর পিছিয়ে থাকা নম্বরের ভিত্তিতে যখন তার প্রতিটি বিষয়ের নম্বর নির্ধারিত হবে, সে নিশ্চিত ভাবে গত বছরের তুলনায় পিছিয়ে যাবে। একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, সেই ছাত্র-ছাত্রীরা সঠিক মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হল।
তাই সবদিক বিবেচনা করে একজন শিক্ষক হিসেবে আমার মনে হয়, কাউন্সিল অযথা একাদশ শ্রেণীর নম্বরটিকে গুরুত্ব না দিয়ে যদি শুধু মাধ্যমিকের নম্বরের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে নতুন কোন স্কেল নির্ধারণ করত, তবে ছাত্র-ছাত্রীদের মূল্যায়ন যেমন অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো, পাশাপাশি বিভিন্ন বিদ্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হতো না।
No comments:
Post a Comment