কবি বিনয় মজুমদারের বাসভবনে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসে একাধিক বই প্রকাশ
নিজস্ব প্রতিবেদন, ২১শে ফেব্রুয়ারিঃ
কবির কথায় ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম’ অথবা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১শে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলতে পারি?’ ভাষা জাতির পরিচয় ও সংস্কৃতিকে বহন করে। যে জাতির ভাষা বা হরফ নেই সেই জাতি অনাথ শিশুর ন্যায় অন্যভাষার উপর নির্ভর করে ধীরে ধীরে নিজের জাতিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।ভারতবর্ষ বহুমাতৃভাষিক দেশ। মাতৃভাষার জনজাতির দিক থেকে ভারতের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। আমাদের সংবিধানে ২২টি ভাষাকে অফিসিয়াল ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০১১ এর আদমশুমারি অনুযায়ী ভারতে প্রায় ১৯,৫০০ এর মতো ভাষা ও উপভাষা ব্যবহারকারী জনগণ রয়েছেন।কিন্তু অধিকাংশ ভাষারই ব্যবহার হচ্ছে শুধুমাত্র নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে।
ধর্মের দিক থেকে এক হলেও শুধুমাত্র ভাষার কারণে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পূর্বপাকিস্তান বাংলাদেশ নামে আত্মপ্রকাশ করে। এমনকি বর্তমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান অস্ত্রই ছিল ভাষা। বর্তমান পাকিস্তান নামক দেশটি জোর করে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে উর্দুভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সারা পূর্বপাকিস্তান ব্যাপী গণআন্দোলনের সৃষ্টি হতে থাকে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ধর্মঘটিরা জমায়েত হলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার অতর্কিতে গুলিবর্ষণ করে এবং সরকারি হিসেবে ৫জন ধর্মঘটি মারা যান।মূলত সেই ঘটনাকেই কেন্দ্র করে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে বিশ্বমাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করতে হয় ১৯৬২ সালে বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষা বাংলার দাবীতেই পুলিশের গুলিতে ১১জন শহীদ হয়েছিলেন বা শুধুমাত্র সমভাষার জন্য আজকের পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
বিশ্বমাতৃভাষা দিবসে পশ্চিমবঙ্গের কিছু লুপ্তপ্রায় ভাষাকে কেন্দ্র করে ঠাকুরনগর থেকে বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে চারটি বই এর সাথে বাংলাভাষায় আরো কিছু স্বতন্ত্র বই প্রকাশ হলো কবি বিনয় মজুমদারের বাসভবনে । উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে ড. অরূপ মজুমদার জানান- ‘ইচ্ছে আছে অন্যান্য জনজাতিতের ভাষা নিয়েও আগামীতে বই প্রকাশ করার। এক্ষেত্রে আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল জাতি বা সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমষ্টিগত উদ্যোগে প্রসারিত, সংরক্ষিত করা। কারণ কালের প্রবাহে এবং বিশ্বায়নের যুগে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ থেকেও ছোট ছোট গোষ্ঠীভুক্ত ভাষাগুলি হারিয়ে যাচ্ছে।’
কবি বিনয় মজুমদারের বাসভবনের ২১শে ফেব্রুয়ারির আজকের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বক্তা ও উদ্যোক্তাদের থেকে জানা যায় যে- ‘লকডাউন পিরিওডে সরকারি সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে অরূপবাবুরা সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে ছোট ছোট গোষ্ঠীভুক্ত ভিন্ন ভাষাভাষী পরিবারগুলির প্রাথমিক ও নিম্নপ্রাথমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং সেই সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে ক্ষেত্রসমীক্ষা করেন। ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়েই তাঁরা অনুধাবন করেন ভাষাগত সমস্যাকে। সেই সমস্যাকে নিরসন করতে এবং জাতির মাতৃভাষাকে প্রসারিত ও সংরক্ষিত করার চিন্তাভাবনা নিয়েই আজকের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান।এই অনুষ্ঠানে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ‘ধ্বনি পরিচয়’(সাদরি ভাষা), ‘কুড়মালি রচিত’, ‘কোড়া রচিত’ এবং ‘কোচ-রাভা রচিত’ নামক চারটি সংকলন প্রকাশ হয়।
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মজয়ন্তীর ২০০ বছরকে সম্মান জানিয়ে, তাঁর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’ এর আদলে ‘ধ্বনি পরিচয়’ (সাদরি ভাষা) সংকলনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব লিপির সন্ধান পাওয়া গেছে, যদিও সেই লিপিত এখনো ভাষা সাহিত্যে প্রয়োগ হয়নি। বিনয় মজুমদার স্মৃতি রক্ষা কমিটি আশাবাদী বাংলার মুণ্ডা জনজাতি অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের হরফ ব্যবহার করতে পারবেন এবং নিজেদের সাহিত্যকে মর্যাদাপূর্ণ আসীনে সক্ষম হবেন।এবং বইটি বাংলার মুণ্ডা জনজাতির পাশাপাশি সকল স্তরের পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে এবং টাইপের সুবিধার্থে বাংলা হরফ ব্যবহার হয়েছে।
‘কুড়মালি’ ভাষা বর্তমানে নৃগোষ্ঠীর ভাষা না হলেও বাঁকুড়া পুরুলিয়া জেলার ‘কুড়মি’ সমাজের একটা নির্দিষ্ট ভাষা রয়েছে। যে ভাষাকে বলা হয় ‘কুড়মালি’ ভাষা। এই ভাষার সাহিত্য অপ্রকাশিতভাবে বেশ সমাদরের মর্যাদা রাখে। তাই এই সংকলনে দেখা গেল কুড়মি সমাজের সকল স্তরের লেখকদের লেখা নিয়ে তাঁদের ভাষা ও সাহিত্যকেই স্থান দেওয়া হয়েছে। সম্পাদক আশাবাদী যে বইটি শুধু ‘কুড়মি’ সমাজের কাছেই আদরণীয় হবেনা; সেই সাথে বাংলার সকল শ্রেণীর পাঠক ও গবেষকের কাছেও সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য হবে।
দুই মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলায় ‘কোড়া’ উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের বসবাসের কথা সর্বজনবিদিত। তাঁদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বেশ প্রসিদ্ধ। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামো ও প্রচেষ্টার অভাবে তা বৃহত্তর পরিসরে প্রকাশ হচ্ছে না- একথা ধ্রুব সত্য। সংকলন সম্পাদক এক্ষেত্রেও চেষ্টা করেছেন ‘কোড়া’ সমাজের সর্বস্তরের লেখকদের প্রাধান্য দিতে। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। কবিতা গল্প প্রবন্ধের সম্ভারে প্রতিটি সংকলনই প্রশংসার দাবী রাখে।
প্রান্তীয় উত্তরবঙ্গের রাভা জনজাতিদের নিয়ে ‘কোচ-রাভা রচিত’ জুড়ে রয়েছে প্রবন্ধ, গল্প, কবিতার পাশপাশি নিত্য ব্যবহার্য শব্দাবলী। এক্ষেত্রেও উক্ত জনজাতিদের রচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেসমস্ত অরাভা লেখকদের রচনা লিপিবদ্ধ হয়েছে এখানে তাঁরাও অন্যবিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে রাভা ভাষা ও সংস্কৃতিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।
এছাড়াও তারা আরো কয়েকটি জনজাতি বা ছোট ছোট গোষ্ঠীর ভাষাকে নিয়ে বই প্রকাশের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছেন।জানা যায় সময় ও অর্থের অপ্রতুলতার দরুণ কাজ আটকে আছে। তবে পর্যায়ক্রমে দ্রুত সেই ভাষার সংকলনগুলিও দ্রুত প্রকাশিত হবে বলে কবি বিনয় মজুমদার স্মৃতিরক্ষা কমিটির অভিমত।
এছাড়াও এই অনুষ্ঠানেই স্বতন্ত্র্যভাবে প্রকাশিত হয় কবি বাবুলাল সরকারের কাব্যগ্রন্থ ‘ইচ্ছে ডানা ৩৪’ ও ‘আধুনিক কাব্যসম্ভার’, তরুণ কবি চিত্তরঞ্জন মণ্ডলের কাব্যগ্রন্থ ‘একাদশীর চাঁদের আলোয়’ সঞ্জীবন মণ্ডল ও প্রকাশ মিশ্র অনূদিত ওড়িয়া ভাষার কবি অরুণ কুমার ত্রিপাঠির ‘ধূসর নায়কের কবিতা’ সহ একটি অনন্য আঁকার বই। যেবইটি জার্মান থেকে মুদ্রিত হয়েছে। অনুষ্ঠানের মুখ্য অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক হরেকৃষ্ণ মণ্ডল (অধ্যক্ষ, গোবরডাঙ্গা হিন্দু কলেজ) সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র মিত্র, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক শ্যামল ভট্টাচার্য। এছাড়াও বাচিক শিল্পী- অনুপম সেনগুপ্ত, দেবদুলাল দে, সংস্কৃতি প্রেমী অনুপম দে, দীপক মিত্র, বৈদ্যনাথ দলপতি, বিশিষ্ট শিল্পী উদয় বিশ্বাস এবং গ্রন্থগুলির প্রকাশক ও বিশিষ্ট শিক্ষক গৌরহরি মজুমদার প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
Very attractive
ReplyDeleteOooo
ReplyDeleteVery nice
ReplyDeleteSomoy upojogi boi
ReplyDelete