Latest Bengali News Portal

Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

Tuesday, June 1, 2021

বিদায় সবুজ সেন: ৫৩ বছরের সহযাত্রা সমাপ্ত!


বিদায় সবুজ সেন: ৫৩ বছরের সহযাত্রা সমাপ্ত!

দীপক পিপলাই

সৌজন্যে : শ্রমজীবী ভাষা ১ জুন, ২০২১


সবুজ সেন সম্পর্কে স্মৃতিচারণে বসতে হবে, এ'কথা কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি!

১৯৬৮ থেকে ২০২১ সাল। ৫৩টা বছর। একজন মানুষকে চেনা-জানা-বোঝার ক্ষেত্রে খুব একটা কম সময় না। বিশেষ করে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক— সব ক্ষেত্রেই যদি সেই সম্পর্কের শিকড় বিস্তৃত থাকে। সবুজদা'র ছোট মেয়ে টুকটুকি (অসিতা সেন) পঁচিশে বৈশাখ বিকালে ফোনে বললো, "কিছু হলো না, দীপুকাকা। বাবা চলে গেলো!" তখন থেকেই অজস্র স্মৃতি ভীড় করে আসছে মনে। কখনও ষাটের দশকে সায়েন্স কলেজে ধর্মঘটের দিনে গেটে জমায়েতের কথা, অথবা শ্লোগান-মুখরিত কলকাতার মিছিলে একসঙ্গে হাঁটার কথা। আবার কখনও সত্তরের দশকে মাদ্রাজ খ্রিশ্চিয়ান কলেজে 'ইন্ডিয়ান স্কুল অব্ সোশ্যাল সায়েন্সেজ'-এর সর্বভারতীয় কনফারেন্সে ই.এম.এস. নাম্বুদ্রিপাদ এবং পি. রামমূর্তির সঙ্গে গ্রুপগত আলোচনায় একসঙ্গে অংশগ্রহণ। এবং হিমাচল প্রদেশে কিম্বা মধ্যপ্রদেশে অথবা গুজরাটে পারিবারিক যৌথভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

অফুরন্ত স্মৃতির কতো আর লেখা যায়! তাই নানা ঘটনার বিবরণে না গিয়ে, বরং মানুষটির কয়েকটি বিশেষ ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা যাক। সবুজ সেনের অবর্তমানে সেটাই মনে হয় বেশি জরুরি।



এক

সবুজ সেন সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনেকেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে লেখেন, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃতত্ত্বের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন।

কথাটা ঠিকই। কিন্তু সেটা সবুজদা'র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনও গুণ নয়। কারণ গত একশো বছরের ইতিহাসে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগ থেকে বহু ছাত্রছাত্রী 'প্রথম শ্রেণীতে প্রথম' হয়েছেন। সবুজ সেনের বৈশিষ্ট্য, শুধু ক্যারিয়ার গড়বার তাগিদে তিনি পড়াশোনা করেননি। ষাটের দশকে 'নকশাল আন্দোলন'-এর উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশে তিনিও ছিলেন একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। রাজনীতি বাদ দিয়ে পড়াশুনো নয়, পুরোদমে বিপ্লবী রাজনীতি করতে করতেই তিনি প্রথম হন। অনেক 'প্রথম'-এর সঙ্গে এখানেই তাঁর তফাৎ।

দুই

যে কোনও বিষয় অধ্যয়নের সময় গভীর থেকে আরও গভীরে ঢুকে পড়া ছিল সবুজদা'র স্বাভাবিক চরিত্র। নৃতত্ত্ব, মার্কসবাদ, ইতিহাস, অর্থনীতি – যে কোনও বিষয়েই তাঁর এই অনুসন্ধিৎসা ছিল লক্ষণীয়। আধাখ্যাঁচড়া জ্ঞান নিয়ে কখনোই ওঁকে তুষ্ট থাকতে দেখিনি। সবুজদা'র যে কোনও লেখাতেই তার প্রকাশ ঘটতো। মাত্র ৩২ বছর বয়স, অমল ঘোষ ছদ্মনামে, তাঁর রচিত মূর্তিভাঙার রাজনীতি ও রামমোহন-বিদ্যাসাগর বইটি যার উদাহরণ হয়ে আছে। ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর মার্কসীয় ভাবনাচিন্তার চমৎকার এক নজির।

অমল ঘোষ নামে ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকান্ডের পর রচিত Assassination of a Tyrant, Continuity of Democratic Dynasty, কিম্বা হিন্দু জাতপ্রথা ও মন্ডল কমিশন ইত্যাদি নানা রচনাতেও ওঁর এই রাজনৈতিক ও সামাজিক গবেষণার মানসিকতা বারবার প্রতিফলিত হয়েছে।

তিন

ষাট-সত্তরের দশকে উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে ইচ্ছামতো ঝাঁপিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে সবুজদা'র বাস্তব সীমাবদ্ধতা ছিল। বঙ্গবাসী কলেজ থেকে নৃতত্ত্ব সহ বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সবুজদা নৃতত্ত্বে 'স্পেশাল অনার্স' নিয়ে এক বছর পড়ার জন্য বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে ভর্তি হন ১৯৬৮ সালে। পাশাপাশি, হাওড়ার নরসিংহ দত্ত কলেজে বোটানির ডেমন্সট্রেটর হিসাবে চাকরিতে যোগ দেন। ফলে, আমাদের মতো সারাদিন ধরে ছাত্র আন্দোলন নিয়ে দাপিয়ে বেড়াবার সুযোগ সবুজ সেন পায়নি। চাকরির জন্য দৌড়তে হতো হাওড়ায়। কিন্তু যতটুকু সুযোগ ছিলো, স্কোয়াডে ডেপুটেশনে গেটমিটিংয়ে ঠিকই যোগ দিতেন। মাথায় সবসময়ে রাজনীতি ঘুরলে যা হয়।

চার

সবুজ'দা নরসিংহ দত্ত কলেজে দীর্ঘদিন লেকচারার পদে থেকে শিক্ষকতা করে। শেষ পর্যন্ত কলেজের সহ-অধ্যক্ষও হয়েছিলেন। অধ্যাপকদের আন্দোলনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করলেও, তাঁর ক্লাস নেবার কাজে কোনও ফাঁকি ছিল না। পড়ানোর গুণে, নৃতত্ত্বের ছাত্রছাত্রীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। নিয়মিত ফিল্ডওয়ার্কের কাজে সবুজ'দা ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলা এক অধ্যাপক। শিক্ষক হিসাবে ছাত্রছাত্রীরা একদিকে তাঁকে যেমন পছন্দ করতো, তেমনি আবার ভয়ও পেতো খুব। কলেজ-শিক্ষক জীবনে খুবই সফল ও সন্তুষ্ট ছিলেন সবুজ'দা।

পাঁচ

অত্যন্ত নিয়মানুবর্তী শিক্ষক হলেও, তথাকথিত "নিরপেক্ষ শিক্ষক" হবার বিরোধী ছিলেন সবুজদা। অধ্যাপকদের আন্দোলনে ছিলেন সদা সক্রিয়। সভায়, জমায়েতে, মিছিলে তাঁর উপস্থিতি ছিলো অনিবার্য। আবার কখনও প্রত্যক্ষ শ্রেণীসংগ্রামের রাজনীতির বাহক হয়ে বারবার হাজির হয়েছেন হাওড়ায় বার্ন স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানীর গেটে অথবা হাজারিবাগের কোলিয়ারিতে শ্রমিকদের মধ্যে। কমিউনিস্ট বিপ্লবী রাজনীতির প্রয়োজনে অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, বিহার ইত্যাদি বিভিন্ন রাজ্যে ছুটে বেড়িয়েছেন। রাজনীতি সচেতন শুধু না, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এই নৃতত্ত্বের অধ্যাপক।

ছয়

রাজনৈতিক জীবনে সবুজ সেনের যাত্রাপথও উল্লেখযোগ্য। সত্তরের দশকে কমিউনিস্ট বিপ্লবী সংগঠন লিবারেশন ফ্রন্ট; আশির দশকে সিওআই(এমএল); নব্বইয়ের দশকে সিপিআইইউ, এবং সিপিআই(এমএল) – প্রতিটি সংগঠনেই নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েই যুক্ত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকেই তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যান। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে আবার কিছুটা রাজনৈতিক কাজকর্ম শুরু করেছিলেন সিপিআই(এমএল) সংগঠনের সঙ্গে। কিন্তু তা ছিল অত্যন্ত সাময়িক এক পর্যায়।

সাংগঠনিক ভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে আর জড়িত না থাকলেও, রাজনৈতিক পড়াশুনো এবং চিন্তা-ভাবনা তাঁর জারি ছিলো জীবনের শেষকাল অব্দি। লেখালিখিও করেছেন। নতুন কিছু ভাবনা-চিন্তার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। 'কোভিড' আক্রান্ত হয়ে আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর সব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা স্তব্ধ হয়ে গেলো ২৫ বৈশাখ ১৪২৮ (৯ মে, ২০২১) তারিখে!

সবুজদা'র মেয়ে অসিতা সেন ১০ মে ফেসবুকে লিখেছে- "আমার বাবা সবুজ সেন কাল চলে গেলেন... চিরবিদায় কমরেড... লাল সেলাম.... নকশালবাড়ি... কানু সান্যাল... বনবিহারী চক্রবর্তী... দীর্ঘ অধ্যায়…"

দৃষ্টান্তমূলক বাপ-বেটি!

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot

Pages