পরীক্ষা বাতিল না করে দেড় ঘন্টার বদলে তিন ঘন্টার পরীক্ষার দাবীতে সরব ABTA
করোনার আবহের জেরে প্রায় বাতিলের পথে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। করোনার এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা না নেওয়াই ঠিক হবে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। কিন্তু পরীক্ষা না নিলে মুল্যায়ন হবে কি করে এ নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। এর মাঝেই শতবর্ষ প্রাচীন শিক্ষক সংগঠন নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে একাধিক পরামর্শ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু সহ পর্ষদ সভাপতি কল্যাণময় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সংসদ সভাপতি মহুয়া দাসকে চিঠি মেইল করেছে।
বিগত ১ ও ৩ জুন,২০২১ তারিখে বর্তমান শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সম্পন্ন করার বিষয়ে প্রশাসনের বক্তব্য হিসাবে যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এবং ৪ জুন,২০২১ তারিখে সরকারের ঘরে জমা পড়া বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপাের্ট সম্পর্কে যা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতি (এবিটিএ)-র পক্ষ থেকে এদিনের চিঠি । চিঠিতে বলা হয়েছে-
১] ২০২০-২১ দীর্ঘায়িত শিক্ষাবর্ষে এই রাজ্যের পর্ষদ আর সংসদের অধীন স্কুলগুলিতে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির প্রস্তুতিকালীন আর পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন-সহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন যথাযথভাবে সম্পন্ন হতে পারে নি। অপরপক্ষে, কেন্দ্রীয় বাের্ডগুলির সম্মিলিত ছাত্র-ছাত্রীসংখ্যা রাজ্য বাের্ডগুলির ছাত্র-ছাত্রীদের মিলিত সংখ্যার তুলনায় নগণ্য; তা ছাড়া এই বাের্ডগুলির স্কুলে বিভিন্ন কারণে ধারাবাহিক অনলাই পঠন-পাঠন এবং অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং কেন্দ্রীয় বাের্ডগুলি বাের্ড পরীক্ষা সামগ্রিকভাবে বাতিল করে সম্পূর্ণভাবে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরীক্ষার্থীদের নম্বর দেওয়ার যে পদ্ধতি নিতে পেরেছে, আমাদের রাজ্য বাের্ডগুলির সেই পদ্ধতি অনুসরণ করার কোনাে উপায় নেই। সুতরাং মাধ্যমিক পরীক্ষা সামগ্রিকভাবে বাতিল করে সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের ভিত্তিতে এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার কিছু বিষয় বাতিল করে গড় নম্বরের ভিত্তিতে পরীক্ষার্থীদের নম্বর দেওয়া সম্ভব হবেনা। এই কারণে আমাদের পরামর্শ এই দুইটি পরীক্ষা সামগ্রিকভাবেই নেওয়া হােক। অতিমারীর প্রকোপ ক্রমশঃ কমছে; প্রয়ােজনে আরও একটু সময় অপেক্ষা করা যেতে পারে। আশঙ্কা অমূলক নয়, যদি এর পরেও জোর করে সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন স্কুলগুলির উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে অস্বচ্ছতা আর অসততার দায়ও জোর করে স্কুলগুলিকে বহন করতে বাধ্য করা হবে, আর যে ফল প্রকাশিত হবে তার মান্যতা এবং নির্ভরযােগ্যতা বলে কিছুই থাকবে না। মাধ্যমিক পরীক্ষা একেবারেই বাতিল হলে, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ভিন্ন স্কুল থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের যথা নিয়মে ভর্তির ক্ষেত্রেও অস্বচ্ছতার সৃষ্টি হবে।
২] পর্ষদ আর সংসদের পরিমার্জিত সিলেবাসে যথাক্রমে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নিতে হবে।
৩] উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সংসদ অনুমােদিত সকল বিষয়ের পরীক্ষা নিতে হবে, কোনাে বিষয়কেই কম গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়ে পরীক্ষা বন্ধ করা যাবে না এবং গড় নম্বরের ভিত্তিতে নম্বর দেওয়া যাবে না। অপশন্যাল ইলেক্টিভ বিষয়ের পরীক্ষা না নেওয়ার বিষয়টি বােধগম্য নয়, কারণ বহু বিষয়ই কোনাে পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে অপশন্যাল আবার অন্য কোনাে পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে কম্পালসারি। তা ছাড়া, যে বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে না, গড় নম্বরের মান দেওয়া হবে, সেই সেই বিষয়ে কলেজে ভর্তির সময়ে মেধাতালিকা প্রস্তুতিতে সততা বজায় রাখা সম্ভব হবে না।
৪] পরীক্ষা ৩ ঘন্টার হতে হবে; দেড় ঘন্টার পরীক্ষাতে সংক্রমণের যা সম্ভাবনা, তিন ঘন্টার পরীক্ষাতে তার খুব হেরফের হবে না। প্রশ্নপত্র ও পরীক্ষার মােট সময়ের মধ্যে সাযুজ্য থাকতে হবে। মাধ্যমিক পরীক্ষা ৯০ নম্বরের, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ৭০ (ল্যাব বেসড় সাবজেক্ট) বা ৮০ (নন ল্যাব বেসড় সাবজেক্ট) নম্বরের হতে হবে। তিন ঘন্টার জন্য তৈরি ৭০, ৮০ বা ৯০ নম্বরের প্রশ্নপত্র থেকে প্রশ্ন বেছে নিয়ে ৫০ নম্বরের উত্তর দিতে বলে পরীক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করা উচিত নয়।
৫] প্রশ্নপত্রের পরিকল্পনায় বর্তমান শিক্ষাবর্ষের বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় সরলতর স্মরণ ও বােধমূলক বহু বিকল্পভিত্তিক, অতিসংক্ষিপ্ত আর সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নকে গুরুত্ব দিতে হবে।
৬] নিজ ঘরে বসে ওপেন বুক সিস্টেমে পরীক্ষা নেওয়া হলে তা রাজ্যের গরিষ্ঠ সংখ্যক সাধারণ পরীক্ষার্থীদের স্বার্থবিরােধী হবে। এই পদ্ধতির জন্য আদর্শ পরিবেশ, মানসিকতা ও দক্ষতার প্রয়ােজন হয়, যা আমাদের সাধারণ আর্থসামাজিক স্তরের পরিবার আর শিক্ষার্থীদের আয়ত্ত করা অসম্ভব না হলেও দীর্ঘ প্রস্তুতি আর অনুশীলনের প্রয়ােজন। তা সত্ত্বেও যদি জোর করে এই পদ্ধতি পরীক্ষার্থীদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে বহু ক্ষেত্রেই নজরদারি আর নিয়ন্ত্রণের উর্ধে অস্বচ্ছতা আর অসততাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হবে।
৭] সার্বিক সুবিধার জন্য পরীক্ষার্থীদের নিজস্ব স্কুলেই পরীক্ষাকেন্দ্র হওয়া উচিত। কিন্তু পরীক্ষা নেওয়ার সময়ে সম্ভাব্য অনিয়ম এড়াবার প্রয়ােজনে ভিন্ন, নিকটবর্তী বিদ্যালয় থেকে তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়ােগ করা উচিত।
৮] পরীক্ষার দিনগুলিতে সকল পরীক্ষার্থী আর সকল ব্যবস্থাপকদের পরীক্ষাকেন্দ্রে স্বচ্ছন্দে ও যথাসময়ে নিয়মিত যাতায়াত করার ব্যবস্থা প্রশাসনকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
৯] পরীক্ষা কেন্দ্রগুলিকে, আগত ব্যবস্থাপক ও পরীক্ষার্থীদের স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে যথাযথভাবে স্যানিটাইজেশন করাতে হবে।
১০] প্রতিটি পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষার সময়ে অবশ্যই স্থানীয় চিকিৎসক থাকার ব্যবস্থা করা দরকার।
১১] উত্তরপত্র সংগ্রহ এবং তা বিলিবন্টন ব্যবস্থা প্রচলিত নিয়মেই করা বাঞ্ছনীয়।
১২] বরাবরের মতাে প্রধান পরীক্ষকের তত্ত্বাবধানেই উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হােক।
১৩] রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আসন্ন মাদ্রাসা পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনাে আলােচনা বা সিদ্ধান্ত প্রকাশ্যে এলােনা। সমিতি এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে ও সিদ্ধান্ত প্রকাশ করার অনুরােধ করছে।
নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাইন বলেছেন- "আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে ইতােপূর্বে বহুবার প্রশাসনের কাছে পঠন-পাঠন, মূল্যায়ন, শিক্ষাবর্ষের দীর্ঘায়িতকরণ ও নজরদারি বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। তার অধিকাংশই উপেক্ষিত হয়েছে; কয়েকটি প্রস্তাব আবার বাধ্য হয়েই গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা আশা করবাে শিক্ষা আর শিক্ষার্থীদের স্বার্থে আমাদের প্রস্তাবগুলি প্রশাসন বিবেচনা করবে ও তাদের অনুকূলে যথাযথ উদোগ নেবে।"
এদিকে রাজ্যবাসীর মতামত জানতে ইতিমধ্যে তিনটি ইমেইল আইডি প্রকাশ করেছে রাজ্য সরকার। মাধ্যমিক - উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে কি ভাবছে রাজ্যের মানুষ তা জানতেই তৎপর হয়ে এই পদক্ষেপ নিয়েছে রাজ্য। শেষ অবধি কি হয় তাই দেখার।
No comments:
Post a Comment