কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো
দীপাঞ্জন দে: নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় রাস্তায় জনসমুদ্র দেখতে পাওয়া যায়। নদিয়া জেলা তো বটেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা এই সময় কৃষ্ণনগরে পুজো দেখতে আসেন। থাকে একাধিক মিডিয়া। কৃষ্ণনাগরিকেরা বছরভর তাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব জগদ্ধাত্রী পুজোর অপেক্ষায় থাকেন। হবে নাই বা কেন? কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্য হল জগদ্ধাত্রী পুজো। এর পরতে পরতে ইতিহাস রয়েছে। কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন ঘিরে একাধিক লোকশ্রুতি রয়েছে। জনপ্রিয় লোকশ্রুতিটি হল নদিয়া-রাজ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নবাব আলীবর্দী খাঁ-র কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জলপথে কৃষ্ণনগরে ফিরছিলেন। সেই সময় নদীঘাটে তিনি বিজয়াদশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে বুঝতে পারেন যে, সেই বছর দুর্গাপুজোর কাল উত্তীর্ণ হয়েছে। এই বিষয়টি মহারাজাকে বিশেষভাবে ব্যথিত করে। সেই রাতেই দেবী দুর্গা জগদ্ধাত্রী রূপে মহারাজার স্বপ্নে আবির্ভূত হন এবং তাঁকে পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী পুজো করার আদেশ দেন। সেই বছর মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রথম রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো করেন। সেই সময় থেকেই নাকি সমগ্র বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়।
অতিমারির দুই বছর অতিক্রম করে ২০২২ সালে কৃষ্ণনগরে যে জগদ্ধাত্রী পুজো হল, সেখানে এক অন্য রকমের উন্মাদনা দেখতে পাওয়া গেল। মানুষের ঢল নামল রাস্তায়। কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো মূলত একদিনেরই পুজো। নবমীর দিনে একসঙ্গে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই চারদিনের পুজো হয়ে থাকে— এটাই কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রীর প্রচলিত রীতি। একমাত্র ব্যতিক্রম হল নুড়িপাড়া বারোয়ারি, সেখানে আগাগোড়াই পুজো চার দিনের। নুড়িপাড়া বারোয়ারির জগদ্ধাত্রী প্রতিমার নামকরণও হয়েছে তাই ‘চারদিনী মা’। হাল আমলে যদিও কৃষ্ণনগরের আরো দু-একটি জায়গায় চারদিনের পুজোর রেওয়াজ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন কৃষ্ণনগরের প্রভাত সংঘ ইতিমধ্যে চার দিন ধরে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করছে।
কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো ২০২২ সালে আড়ম্বরের দিক থেকে মনে হয় পূর্বের সকল মাত্রা ছাপিয়ে গেল। একাধিক চমক দেখতে পাওয়া গেল এই বছর। শহরের প্রান্তে মিউনিসিপালিটির চার নম্বর ওয়ার্ডে দেখা মিলল বিশ্বের সবথেকে বড় জগদ্ধাত্রীর। সন্ধ্যারামনগরের ক্লাব প্রতিভা। এই বছর তারা ৫২ ফুট লম্বা জগদ্ধাত্রী প্রতিমা গড়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। ক্লাব কর্তৃপক্ষের দাবি এটি বিশ্বের সবথেকে বড় জগদ্ধাত্রী, যার সর্বমোট উচ্চতা ৬৪ ফুট। ৫২ ফুট হল প্রতিমার উচ্চতা, আর ১২ ফুটের মুকুট। ক্লাব প্রতিভার জগদ্ধাত্রী পুজোকে কেন্দ্র তাদের ক্লাবের মাঠে প্রায় ৪-৫ দিনের মেলাও বসতে দেখা যায়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রীর পাশাপাশি হাতার পাড়ার লিচুতলায় দেখা মিলল জীবন্ত জগদ্ধাত্রীর, আয়োজক প্রজাপিতা ব্রহ্মাকুমারী ঈশ্বরীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আবার ইন্দিরা পল্লী বারোয়ারির বিশেষ আকর্ষণ ছিল কয়লা খনি। তাদের পুজো এবারে ৩৫তম বর্ষে পদার্পণ করল। পাত্র বাজারের স্বীকৃতি ক্লাবের থিম ছিল দিল্লির লালকেল্লা, তাদের মণ্ডপে বিশেষ লেজার শো দেখে সকলে মুগ্ধ হন। বাগদিপাড়া বারোয়ারি বিখ্যাত কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথকে এই বছর তাদের মণ্ডপসজ্জার মধ্যেদিয়ে বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য জানায়। প্রতিবছরই কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর বিশেষ আকর্ষণ থাকে ক্লাব রেনবোর পুজো। এবছর তাদের পুজোর বিশেষ আকর্ষণ ছিল চারধাম।
নগেন্দ্রনগরের ক্লাব যুবগোষ্ঠীর বিশেষ আকর্ষণ ছিল জারোয়ার দেশ আন্দামান। রাধানগর আদি বারোয়ারির (সেরামা) ২০২২ সালের পুজোর বিশেষ আকর্ষণ ছিল আদি যোগী। ঘূর্ণি আনন্দনগর বারোয়ারির থিম ছিল বদ্রিনাথ। ঘূর্ণি নবারুণ সংঘের জগদ্ধাত্রী ‘মা নবারুণেশ্বরী’ নামে পরিচিত। তাদের এবারের থিম ছিল ইন্ডিয়া গেট। ঘূর্ণি তুফান সংঘ থিম করেছিল আইফেল টাওয়ার, যার লাইটিং সকল দর্শনার্থীর দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। ঘূর্ণি ঘরামী পাড়া বারোয়ারির ২০২২ সালের বিশেষ আকর্ষণ ছিল কেদারনাথ। ঘূর্ণি আদি ঘরামী পাড়া বারোয়ারি থিম করে জল নেই জীবন নেই। ঘূর্ণি স্মৃতি সংঘের বিশেষ আকর্ষণ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ পৃথিবী। ঘূর্ণি বিন্দু পাড়া বারোয়ারির থিম ছিল মৎস্যকন্যা। ঘূর্ণি দাসপাড়া বারোয়ারির জগদ্ধাত্রী হল কৃষ্ণনগরের অন্যতম পুরনো পুজো। ২০২২ সালে তাদের থিম ছিল ফাঁসির মঞ্চ। এরকমই আরো অনেক বিষয় ভাবনা ২০২২ সালে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোয় দেখতে পাওয়া যায়। দর্শনার্থীরা এবছর জগদ্ধাত্রী পুজোর এই স্বাদ আস্বাদন করে নিশ্চয় খুব আনন্দিত হয়েছেন।
লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া।
No comments:
Post a Comment