Latest Bengali News Portal

Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

Friday, November 11, 2022

Nabadwip Rash Yatra Utsav- নদিয়ার নবদ্বীপ মানেই হল রাসের নগর

নবদ্বীপের রাস - Nabadwip Rash Yatra Utsav

Nabadwip Rash Yatra Utsav



দীপাঞ্জন দে : নবদ্বীপের রাস— দারুণ এক ব্যাপার। পুরো নবদ্বীপ শহর রাসের সময় যেন এক অন্য চেহারা নেয়। ছোট-বড় মিলিয়ে নবদ্বীপে বর্তমানে প্রায় ৩০০টির বেশি প্রতিমা রাসের সময় দেখতে পাওয়া যায়। নবদ্বীপের রাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল রাসের ক্লাব, বারোয়ারিগুলির সুবিশাল প্রতিমা। নবদ্বীপের রাসের প্রতিমার উচ্চতা হয় মোটামুটি ২৫ ফুট থেকে ৩০ ফুট। তবে শুরুতে নবদ্বীপের রাসের প্রতিমা এত বড় হত না। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে যখন রাস পূর্ণিমায় পণ্ডিতেরা মাটির মূর্তি গড়ে পুজো শুরু করেছিলেন, তখন প্রতিমাগুলি ৪ ফুট থেকে ৫ ফুট উচ্চতার হত বলে জানা যায়। পরবর্তীতে সেগুলির উচ্চতা বৃদ্ধি পায় এবং রাসের সময় প্রায় ৭ ফুট থেকে ৮ ফুটের প্রতিমা করা হয়। নবদ্বীপে এত বৃহৎ আকারের প্রতিমা নির্মাণের সূচনা হয়েছিল নদিয়া-রাজ মহারাজা গিরিশচন্দ্রের আমলে, ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। যদিও সেই প্রতিমার সঙ্গে রাসের কোনো সম্পর্ক ছিল না। নদিয়া-রাজ গিরীশচন্দ্রের দেওয়ান হরগোবিন্দ প্রামাণিক চৈত্রমাসের বাসন্তী পুজোর সময় ৩৬ ফুট উঁচু ‘হটহাটিকা’ বা ‘বাসন্তীমূর্তি’ পুজো করেন। সেই থেকেই নবদ্বীপে বড় প্রতিমার রেওয়াজ শুরু হয়। এই ঘটনার পরের বছর থেকেই রাসের প্রতিমাগুলির উচ্চতা বাড়তে শুরু করে। বর্তমান সময়ে নবদ্বীপের রাসের মজাই হল বৃহদাকার বৈচিত্র্যপূর্ণ সব প্রতিমা।




রাসের সময় বহু দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা চৈতন্য নগরীতে এসে উপস্থিত হন। সমগ্র নবদ্বীপ রাস পূর্ণিমায় যেন এক অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে। আসলে নদিয়ার নবদ্বীপ মানেই হল রাসের নগর। নবদ্বীপের রাস হল সমগ্র নদিয়া জেলার উৎসবগুলির মধ্যে এক শ্রেষ্ঠ উৎসব। নবদ্বীপের রাসের খ্যাতি জগৎজোড়া। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি জায়গায় এখন রাস হয়। কিন্তু নবদ্বীপের রাস পুরোপুরি স্বতন্ত্র বলা চলে। এখানে শক্তি আরাধনার প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। নবদ্বীপের রাসকে তাই ‘শাক্তরাস’ বলা হয়।




নবদ্বীপের রাসে কয়েকশো বিচিত্র দেবদেবী পূজিত হন। যেন মনে হবে দেবদেবীদের এক মহামিলন। তাদের রূপ, পুজো পদ্ধতি সবই ভিন্ন। সমগ্র ভূ-ভারতে এত দেবদেবীর পুজো আর কোথাও হয় বলে জানা যায় না। বৈষ্ণবদের খুব প্রিয় উৎসব হল রাস। কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় রাস উৎসব হয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নবদ্বীপে প্রথম রাসযাত্রার সূচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। বৈষ্ণব ভাবধারায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে ভক্তদের মিলন উৎসব হল রাস। ‘রস’ শব্দটি থেকে এসেছে রাস। আর শ্রীকৃষ্ণ হলেন মধুর রসের ঘনীভূত আধার। শারদপূর্ণিমার রাতে শ্রীকৃষ্ণের আহ্বানে বৃন্দাবনের যমুনাতটে গোপিনীরা এসেছিলেন এবং ভগবানের সঙ্গে মিলিত হন। তবে বৈষ্ণবীয় ভাবধারার এই রাসযাত্রার সাথে নবদ্বীপের রাসের অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে। নবদ্বীপের বৈষ্ণবীয় রাসে মঠ-মন্দিরগুলিতে পটুয়াদের দিয়ে বড় বড় পট আঁকানো হত এবং সেগুলি প্রদর্শিত হত। পটগুলিতে রাসলীলার বিভিন্ন ছবি আঁকা হত। সে সময় রাসপূর্ণিমার আর এক নাম ছিল ‘পট পূর্ণিমা’। এছাড়া গরুর গাড়ির চাকার থেকেও বড় বড় কাঠের চাকা তৈরি করে তার মাঝখানে রাধাকৃষ্ণকে বসানো হতো এবং চারপাশে থাকত অষ্টসখীর মূর্তি। তারপর ধীরে ধীরে সেই চাকাটি ঘোরানো হত, যাকে বলা হত ‘চক্ররাস’। মহাপ্রভুর পরবর্তীকালে নবদ্বীপের রাসযাত্রায় বৈষ্ণবীয় ভাবধারার প্রভাব কমতে থাকে। অন্যদিকে শক্তিমূর্তির আরাধনা বৃদ্ধি পায়। নবদ্বীপের রাসে শাক্ত ভাবধারার প্রভাবে কার্তিক পূর্ণিমার রাতে শত শত শক্তিমূর্তির পূজো হয়।




নবদ্বীপে শাক্তরাসের প্রবর্তক হিসেবে নদিয়া-রাজ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের (১৭২৮-১৭৮২খ্রি.) কথা বলা হয়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন শাক্ত। ১৭৫২ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে তিনি নবদ্বীপের রাসে শক্তিমূর্তির আরাধনায় উৎসাহ দিতে শুরু করেন বলে মনে করা হয়। নদিয়া-রাজের পৃষ্ঠপোষকতায় শীঘ্রই নবদ্বীপের রাসোৎসব বৈষ্ণবীয় রাসকে ছাপিয়ে যায়। নবদ্বীপে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের বাস ছিল। স্মৃতি এবং নব্যন্যায়ের বড় বড় পণ্ডিতেরা ছিলেন। তারা দুর্গাপুজোর সময় নিজ নিজ যজমানের বাড়িতে যেতেন। বাড়ি ফিরতেন দীপান্বিতার পর। বাড়ি ফিরে সেই সব পণ্ডিতেরা কার্তিক পূর্ণিমায় নিজেদের বাড়িতে ঘট স্থাপন করে ইষ্টদেবীর পুজো করতেন। সেখানে কোনো মূর্তি থাকতো না। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর আমলে ঘোষণা করেছিলেন, যারা ঘটের বদলে মাটির মূর্তি গড়ে পুজো করবেন, তারা রাজানুগ্রহ পাবেন। বিখ্যাত নৈয়ায়িক শঙ্করনাথ তর্কবাগীশ মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এই ঘোষণায় প্রথম সাড়া দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপণ্ডিত। শঙ্করনাথ তর্কবাগীশ নবদ্বীপের দেয়ারাপাড়ায় প্রথম আলোকনাথ কালীর মূর্তি নির্মাণ করে পুজো করেন, যা ‘এলানিয়া কালী’ নামে পরিচিত। নবদ্বীপের রাসের প্রথম প্রতিমা হিসেবে এটিকেই চিহ্নিত করা হয়। ঘোষণা মতো মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র অলোকনাথ কালীর পুজো ষোড়শোপচারে যাতে হতে পারে তার জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন। সেই থেকেই শুরু। নবদ্বীপের বড় বড় পণ্ডিতেরা রাজানুগ্রহ পাওয়ার আশায় নিজ নিজ ইষ্টদেবীর মূর্তি গড়ে কার্তিক পূর্ণিমায় পুজো শুরু করেন। শঙ্করনাথ তর্কবাগীশ কর্তৃক আলোকনাথ কালী মূর্তি নির্মাণের ঠিক পরের বছরেই সীতিকণ্ঠ বাচস্পতি নির্মাণ করেন ‘শবশিবা’ মূর্তি। একই বছরে ব্যাদড়া ব্রাহ্মণেরা নিজেদের পল্লীতে শবশিবা পুজো শুরু করেন। অন্যদিকে ভুবনমোহন বিদ্যারত্ন দণ্ডপাণিতলায় মুক্তকেশী মাতার পুজো শুরু করেন। এভাবেই নবদ্বীপের রাসে রাজানুগ্রহে শক্তির আরাধনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রতিবছর কার্তিক পূর্ণিমায় নিজেদের পছন্দমতো মূর্তি গড়ে নবদ্বীপের পণ্ডিতেরা শক্তির আরাধনা করতে থাকেন। শীঘ্রই শক্তিমূর্তির প্রাধান্য নবদ্বীপে বৈষ্ণবীয় রাসকে ছাপিয়ে যায়। শুধু মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নয়, তাঁর উত্তরপুরুষেরাও শক্তি আরাধনার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলে জানা যায়। আর সেই পরম্পরা ধরেই ক্রমান্বয়ে নবদ্বীপের রাস আজকের রূপ নিয়েছে।




লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot

Pages