হারাতে বসেছে জল্পেশ মেলার প্রাচীন ঐতিহ্য 'দই চিড়া' খাওয়ার রীতি
মধুসূদন রায়, ময়নাগুড়ি, ২০ মার্চ : আজ থেকে কয়েকদশক আগেকার কথা। তখন, এখনকার মতন অত্যাধুনিক যান বাহন ছিল না। দূর থেকে দূরান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা পায়ে হেঁটে কিংবা গরুর গাড়িতে করে উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী ময়নাগুড়ির জল্পেশ মেলায় আসত। এখনো সেই কথা মনে পড়লে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন প্রবীণরা। জানা গেছে, মন্দিরে পুজো দিয়ে, জল্পেশ মেলায় আগত পুণ্যার্থীরা দই চিড়া খেতেন। তখন জল্পেশ মেলার একটা অন্যতম জৌলুস ছিল এই দই-চিড়া।
জল্পেশ মেলায় এসে দই চিড়া খায়নি এমন ব্যক্তির সন্ধান খুবই কম মিলত। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় জল্পেশের দই চিড়ার জৌলুস এখন ভাটার টান। এর ফলে জল্পেশ মেলার ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে বলে মনে করছেন অনেকেই। ফাস্টফুড এবং বিভিন্ন রকমারি খাবারের প্রতিযোগিতায় ক্রমশ হারাতে বসেছে জল্পেশের ঐতিহাসিক খাওয়ার দই চিড়া।
এখনো জল্পেশ মেলায় দই চিঁড়া পাওয়া গেলেও হিরিকটা খুবই কম। এর ফলে বংশ পরস্পরায় জল্পেশ মেলায় দই চিড়ার দোকান দিয়ে আসা বিক্রেতাদের যেমন কপাল ভাঁজ, ঠিক তেমনি মেলার ঐতিহ্য হারিয়ে যাওযায় মেলার 'ঐতিহ্য বিলুপ্তি' বলে মনে করছেন প্রবীণরা। তাদের কথায়, জল্পেশ মেলায় আসলে দই চিড়া না খেলে, মেলায় আশাই মনে হয় না। তবুও পুরানো ঐতিহ্য বজায় রেখে জল্পেশ মেলায় দই চিড়া খেতে দেখা যায় গ্রামের প্রবীনদের। তবে সেটাও হাতে গোনা যায় বলে দাবি করেছেন দই চিড়া বিক্রেতারা।
দই চিড়া খেতে থাকা ষাটার্ধ বৃদ্ধা অলকা বর্মনের কথায়, সেই ছেলেবেলা থেকে জল্পেশ মেলায় আসছি। পূজা শেষে দই চিঁড়া খাওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে এখানকার দই চিড়ার যে অন্যরকম স্বাদ রয়েছে তা স্বীকার করে নেন বছর তিরিশের যুবক রনজিত রায়। রণজিৎ রায়ের কথায়, শুনেছি আগে দই চিড়ার দোকানে লাইন পড়ে যেত। এখন তা না হলেও এখানকার দই চিঁড়ার যে অন্যরকম স্বাদ রয়েছে তা অস্বীকার করতে পারবে না কেউ।
জল্পেশ মেলায় আগত চ্যাংড়াবান্ধা এলাকার বাসিন্দা অমিত কুমার বলেন, "আমি ছোট বেলা থেকে মেলায় আসি এবং দই চিড়া খাই। আমার খুব ভালো লাগে খেতে। ছোট থেকে যখন বাড়ির অভিভাবকদের সাথে আসতাম তখন থেকে দই চিড়া খেতাম। বর্তমানে এর হিড়িক অনেকটাই কমেছে। এর অন্যতম কারণ অভিভাবকরা বাচ্চাদের এখন এইসব খাবারের প্রতি আগ্রহ দেখান না ফলে পরবর্তী প্রজন্মও আগ্রহ হারাচ্ছে।" আরেক পুণ্যার্থী সঞ্জয় দাম বলেন, " এই জৌলুশ হারিয়ে যাচ্ছে। বলতে গেলে জল্পেশের একটা ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন ফাস্টফুড জাতীয় বিদেশি খাবারের প্রতি ছেলে মেয়েদের আগ্রহের জন্যই এই দেশীয় খাবার হারিয়ে যাচ্ছে।"
ময়নাগুড়ির উত্তর ভূষকাডাঙ্গা এলাকার দই চিড়া দোকানের ব্যবসায়ী পবিত্র দাম এবং নিবাস রায় বলেন, " তিরিশ বছর ধরে এই মেলায় দই চিঁড়ার দোকান করছি। কিন্তূ আগের তুলনায় বর্তমানে এর চাহিদা একেবারে নেই বললেই চলে। ফলে আমাদের ব্যবসাতেও টান পড়েছে। এই অবস্থা থাকলে হয়তো একদিন জল্পেশ মেলা থেকে দই চিড়া খাওয়ার রীতি একদিন হারিয়ে যাবে।"
No comments:
Post a Comment