সম্প্রীতির মেলবন্ধন হাঁসপুরের বনবিবির পূজা
লিপিকা সোম, হাঁসপুর, গাইঘাটা:
সুন্দরবন অঞ্চলের ‘বনবিবি’র উপাখ্যান সম্বন্ধে কমবেশি আমরা সকলেই জানি।কিন্তু সুন্দরবন থেকে অনেকদূরে গাইঘাটা ব্লকের ‘হাসঁপুর’ অঞ্চলে ‘বনবিবি’র পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রায় শতাধিক বছর থেকে। সুন্দরবন অঞ্চলে মূলত বাঘ, সিংহ ও হিংস্র বন্যপশুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই মুসলমান সমাজে ‘বনবিবি’র আরাধনার প্রচলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে এই বনদেবী হিন্দুদের দেবদেবতায় স্থান পেয়েছে।রীতিমত সমস্ত রকম রীতি মেনেই বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণ হয়েছে প্রচুর মন্দির। কিন্তু এই অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ আজও পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ্যভাবে এই পূজাতে অংশগ্রহণ করেন।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার গাইঘাটা ব্লকের হাঁসপুর বাজারের বনবিবি দেবীর মন্দিরে প্রতিবছরের মতো এবছরও মহা ধূমধামে অনুষ্ঠিত হল বনবিবির পূজা ও মেলা। প্রতিবেদক সেই মেলা সম্বন্ধে স্থানীয় লোকজনদের সাথে কথা বলে জানতে পারেন যে- দেশভাগের পূর্ব থেকেই গাইঘাটা ব্লকের এই স্থানটি ছিল গভীর জঙ্গলে ভরা এবং কিছু মুসলমান সম্প্রদায় এখানে বসবাস করতেন।যাঁদের মূল জীবিকা ছিল কৃষিকাজ ও জঙ্গল থেকে জীবন ধারণের জন্য বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করা। ফলে এই জঙ্গলে বাঘ সিংহ সহ অন্যান্য জীবজন্তুর হাতে তাঁরা সহজেই আক্রান্ত হতেন। শুধু তাই নয় তাঁদের গৃহপালিত পশু পাখিও বন্য জীবজন্তদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হত। তাই এই অঞ্চলেও সুন্দরবনে পূজিত বনবিবির আরাধনা শুরু হয়। কথিত আছে যে সেই আরাধনায় দেবী সাড়া দিয়ে তাঁদের রক্ষা করতেন।
কিন্তু দেশভাগের পরে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দু জনসংখ্যার বিস্তার হয় স্বাভাবিকভাবে। ফলে জঙ্গল কেটে স্থাপন হতে থাকে বসতি। সেই সুত্রেই ‘বনবিবি’র আরাধনার ক্ষেত্র পরিবর্তন হয়ে যায়। মুসলমানদের আরাধ্যা রূপান্তরিত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবী হিসেবে। দুইদিন ধরে পূজিত হতে থাকেন এই মন্দিরের ‘বনবিবি’ দেবী। এখানে মুসলমানরা মানত করেন, হিন্দুরা সরাসরি দেবী পূজায় নিয়োজিত হন।যদিও এই পূজায় পুরোহিত নেওয়ার চল নেই, তবুও হাঁসপুরের বনবিবি মন্দির কমিটি জানান যে- মানুষের মঙ্গলের জন্য এই মন্দিরে পুরোহিতের মাধ্যমে বর্তমানে পূজা করা হয়।
ফাল্গুন মাসের সংক্রান্তিতে হাঁসপুর বাজারে ‘বনদেবী’র স্থায়ী মন্দিরে নৃ-গোষ্ঠী থেকে শুরু করে সমাজের সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষদের আনাগোনা অতি সহজেই লক্ষ্য করা যায়।স্থানীয় বয়স্ক ব্যক্তিদের অভিমত হল- ‘বিবি’ শব্দটি মুসলমান সমাজেই ব্যবহৃত হয়; তাই এই অঞ্চলে বনবিবির আরাধনা তাঁরাই করেছিলেন। এমনকি পূর্বে মুসলমানদের জমিতেই এই আরাধনার আসর বসলেও বর্তমানে মন্দির কমিটি নিজস্বভাবে জমি নিয়ে মন্দির স্থাপন করেছেন। এই প্রসঙ্গে নৃ-তত্ত্ব গবেষক ড. অরূপ মজুমদার অভিহিত করেন যে-“মানুষ যখনই বিপদে পড়েছে, তখনই তাঁরা দেবদেবীর আরাধনা করে মুক্তির উপায় খুঁজেছে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা ধর্ম ও বর্ণকে তেমন প্রাধান্য দেয়নি।তাই এখানকার বনদেবীর আরাধনা মুসলমান সমাজে শুরু হলেও হিন্দু সমাজে তা পূজার আকার ধারণ করেছে এবং নৃ-গোষ্ঠী সমাজের লোকজনও মানত দান করে দেবীকে সন্তুষ্ট রাখতে পূজায় অংশগ্রহণ করছেন। যেমনটি আমরা হলদিবাড়ির হুজুর সাহেবের মেলায় দেখতে পাই। সেখানেও হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে দরগায় মানত করেন।একই ভাবে হিন্দু ধর্মে গোরক্ষ নাথের নামে ষাঁড় ছেড়ে দেওয়ার প্রথা যেমন প্রচলিত আছে তেমনি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে পীরের নামে ষাঁড় ছেড়ে দেওয়ার প্রথাও প্রচলিত”।
![]() |
লিপিকা সোম, হাঁসপুর, গাইঘাটা |
No comments:
Post a Comment