উপসম্পাদকীয়
ফেসবুকে ভোটযুদ্ধ ও বাংলার ভোটসৈনিক
ড. সঞ্জীবন মণ্ডল
বাঙালি বরাবরই আবেগপ্রবণ জাতি।ভোট এলে তো কথাই নেই। ভোটের মিটিং মিছিল শ্লোগানে বাঙালির তুলনা হয়না। এযেন এক উৎসব।কিন্তু এই উৎসবের কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে গত লোকসভার পরে।যেখানে গ্রামাঞ্চলগুলিতে বাংলাদেশের রাজনীতির ছায়া লক্ষ্য করা গেছে। জেতা পার্টি মেরেছে হারা পার্টিকে; সুযোগ বুঝে হারা পার্টিও মেরেছে জেতা পার্টিকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেছে গ্রামাঞ্চলের অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত প্রান্তিক স্তরের নেতারাই আক্রমণের শিকার হয়েছেন। সবটাই হয়েছিল ব্যক্তিগত রোষানল বা গ্রামীণ দলাদলিকে কেন্দ্র করে। স্বাভাবিকভাবেই এবছরের বিধানসভা নির্বাচনে গ্রামাঞ্চলের কর্মীদের মধ্যে উৎসব উৎসব মনোভাবটা একটু কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তার সাথে করোনা শিক্ষা দিয়েছে যে কর্মের নিশ্চয়তা এবং খাদ্য সঞ্চয় না থাকলে কি ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
পশ্চিমবঙ্গের ভোটকে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড বা ওড়িশ্যার ভোটমরশুমের সাথে তুলনা করলে চলবেনা। ঐ সমস্ত রাজ্যের ভোট যাঁরা প্রত্যক্ষ্যভাবে দেখেছেন তাঁরা সকলেই অভিহিত আছেন যে- সেখানে মিছিল শ্লোগানের মধ্যে তেমন আবেগ নেই। পতাকা লাগানো দামী দামী গাড়ি ও বাইকের কিছু মিছিল লক্ষ্য করা গেলেও শ্লোগানে হৈহৈ রব ছাড়া তেমন কিছু লক্ষ্য করা যায়না। এই সমস্ত রাজ্যে ভোটের দিন বন্ধের আকার ধারণ করলেও দিন শেষে দেখা যায় সরকার নির্ধারণে মাত্র ৫৫-৬৫ শতাংশ নাগরিক অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ৮০ শতাংশের নীচে ভোট ভাবাই যায়না।
যাইহোক, বাংলার ভোটের আবহে সাধারণ শিক্ষিত শ্রেণী রাস্তায় নেমে ভোট উৎসবে তেমনভাবে সামিল না হলেও ঘরে বসে ফেসবুকে এক একজন ঝড় তুলছেন। এই ঝড়ে কখনো কখনো পার্টিকে উপেক্ষা করে ব্যক্তি আক্রমণে কদর্যভাষা প্রয়োগ পূর্বে পরিলক্ষিত হয়েছে বলে মনে হয়না।নকশালবাড়ি এলাকার একজন ভোট বিশেষজ্ঞকে কানু সান্যালের সাথে তুলনা করা দেখে মনে হল আক্রমণকারী কানু সান্যালকে কাছ থেকে দেখেছেন। আবার মিনাক্ষী মুখার্জীকে একজন আক্রমণ করেছেন- ‘৩৭ বছর বয়স, এই বয়সে রোজগার না করে পার্টির পিছনে ছুটলে তো আর্থিক দৈন্যতা থাকবেই’। আমি নিশ্চিত সেই বিশেষজ্ঞ ঘরে বসে পাড়ার অশিক্ষিত নেতাটিকেও শিক্ষাগতযোগ্যতার নিরীখে আক্রমণ করতে পিছপা হননা। শিক্ষিত লোক রাজনীতিতে এলেও মুস্কিল না এলেও মুস্কিল। তবে কি ড. জয়ন্ত রায়, ড. সুকান্ত মজুমদার ড. সুখবিলাস বর্মা মহাশয়েরা ভুল করেছেন? অধীর চৌধুরীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও অনেক ফেসবুক ভোট বিশেষজ্ঞ উঠে পড়ে লেগেছেন।কিন্তু আণ্ডার ম্যাট্রিক অধীর চৌধুরীর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কতজন আছে বাংলায়?
প্রার্থী মনোনয়ন না পেয়ে যারা কান্না করেছিলেন বা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তাঁদের নিয়েও ট্রোল কম হয়নি। শম্পা দড়িপা মহাশয়ার অভিমান দেখে তাঁর অনেক কর্মী ও সমর্থকরাই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন ফেসবুকে। কিন্তু মহাশয়ার অভিমান কমে গেলে ফেসবুকে সেইসমস্ত সমর্থকদের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞতাপূর্ণ পোস্ট খুব একটা দেখা যাচ্ছেনা। আরাবুল ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই। সেই তালিকায় আমরা শ্রীযুক্ত দীপেন প্রামাণিক ও গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা মহাশয়দের সমর্থকদেরও রাখতে পারি।
Join Our Whatsapp Group:
রাজনৈতিক দল যাঁরা পরিবর্তন করে অন্য দলের প্রার্থী হয়ে লড়ছেন তাঁদের নিয়ে ফেসবুক ভোট বিশেষজ্ঞরা এখনও সমানভাবে লড়ে যাচ্ছেন। তাই তো অনেকেই শুভেন্দু অধিকারীকে যা ইচ্ছে তাই সম্বোধনে শান্তি পাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে কেন্দ্র ফেসবুকের বাইরে অনশন মঞ্চ পর্যন্ত হয়ে গেছে। শিলিগুড়ির শংকর ঘোষের দলপরিবর্তনে ফেসবুকে ভদ্রস্বরূপ তর্কের হাওয়া লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ শংকর ঘোষের ভোটপ্রচারের ধরণ দেখে অনেকেই চুপ হয়ে গেছেন। ওমপ্রকাশ বাবুকে তো এক শ্রেণীর লোক ঘরে বসে ‘টাকলা’ অভিহিত করে বীরত্ব প্রকাশ করছেন।
ঐশী ঘোষ, দীপ্সিতা ধর, আকিক হাসান, সৃজন ভট্টাচার্য, প্রতীকুর রহমানদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা দুর্নীতি বিষয়ক কোন পোস্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা কিন্তু ৭ শতাংশের কম বলে আক্রমণ করে অনেকেই ফেসবুকের ওয়াল ভরিয়ে দিচ্ছেন।গঙ্গার উপর মদন মিত্রের দোলউৎসবের ভিডিও নিয়ে কত যে কমেন্ট উঠে আসছে তা না বলাই ভালো।
করোনাকালের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই ফেসবুক ভোট বিশেজ্ঞরা যেন একেকজন অর্থনীতিবিদ, ডাক্তার, নেতা হয়ে উঠেছেন।সকাল থেকে রাত অবধি তাঁরা বিশেজ্ঞতার পরিচয় দিয়েই যাচ্ছেন। আমাদের রাজ্যে এত ফেসবুক ভোট বিশেষজ্ঞ থাকতেও শীতলকুচি কেন শিরোনামে এল? মদন মিত্র, সুজন চক্রবর্তীরা কেন বেসরকারী হাসপাতালে ভরতি হল? রাজার হাটে কৃষক কেন টম্যাটো, করলা ফেলে দিয়ে খালি পকেটে বাড়ি ফিরল? ফেসবুক ভোট বিশেষজ্ঞগণ ফেসবুকে আবদ্ধ না থেকে রাস্তায় নামুন; ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের বিশেষজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জাতিকে উদ্ধার করুন।
একেবারে সঠিক পর্যবেক্ষণ । ধন্যবাদ জানাই লেখককে।
ReplyDelete