সাহিত্যের মুক্তাঙ্গন : ফেসবুকের গণসাহিত্য
ড. সঞ্জীবন মণ্ডল
‘কার কাছে যাবো আমি মাতাল সমীরে
কোন দিকে পথ আছে অনন্ত আঁধারে
ভেতর ভীষণ কেন আঘাত প্রবণ
বসন্ত বিচ্ছিন্নতা কালবৈশাখী ধরন’
নামহীন কবিতার স্তবকটির রচয়িতা কবি অধ্যাপক তন্ময় বীর।নিজের ফেসবুকওয়ালে। দীর্ঘদিন আগে পোস্ট করেছিলেন। মাঝে মাঝেই কবির ওয়ালে ছোট ছোট ভাবগম্ভীর্যপূর্ণ কবিতা দেখতে পাওয়া যায়। সাহিত্যাঙ্গনে ফেসবুক এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে কবি ব্যক্ত করেন নিজের মনের কথা; সাথে সাথেই পাঠক প্রতিক্রিয়া কবির বক্তব্যকে চুলচেরা বিশ্লেষণে ভরিয়ে তোলে। এক্ষেত্রে কবি যদি অর্থহীন বাক্য ও শব্দের বিন্যাস করেন তবে তো কথাই নেই, ব্যঙ্গবানে বিদ্ধ হয়ে কবি পিছনপানে ছুটতে বাধ্য হবেই। একই সাথে একই মঞ্চে সাহিত্যিক ও সমালোচক বিরাজ করেন। ফলে সোসালমিডিয়া মঞ্চে সাহিত্যিককে সচেতন থাকতে হয়।
তন্ময় বীরের কবিতা দিয়েই শুরু করলাম। তন্ময় বীর খুব বেশী কবিতা লেখেননা। অধ্যাপনা ও গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি মূলত একজন প্রাবন্ধিক। বাংলার বাইরে বাংলাচর্চা বিষয়ে জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাশের পরেই তন্ময় বীরের অবস্থান- একথা অস্বীকার করা যাবেনা। কিন্তু তিনি যখন কবিতাকারে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন; তা যেমন অর্থবহ হয় তেমনি হয় দুর্বোধ্য। এই দুর্বোধ্যতার কারণেই তন্ময় বীরের কবিতায় বেশী কমেণ্ট হয়না। কিন্তু যে’কটি কমেণ্ট উঠে আসে সেই কমেণ্ট পাঠ করেই অনেকে মূল কবিতার রসদ সংগ্রহ করেন। এখানেই একজন কবির সার্থকতা। ছন্দ মিলিয়ে ছড়া তো অনেকেই লেখেন কিন্তু কবিতা লেখেন কতজন? সংখ্যায় কম লিখলেও অর্থবোধক ও ব্যঞ্জনাবোধক দিক থেকে তন্ময় বীরের ফেসবুকের কবিতা একই সাথে একটা বিরাট চিন্তাচেতনাকে তুলে ধরে। কবির প্রকাশিত ‘বাক্যালাপ, কথালাপ ও অন্যান্য’ কাব্যসংকলনেও এই প্রতিফলন দেখা গেছে।ফেসবুক থেকেই পড়া কবির অপর একটি কবিতার প্রসঙ্গ আমাকে ভাবায়। আশা করছি যারা কবিতাটি পাঠ করেছেন তারাও খুব সহজেই ছোট্ট এই কবিতাটি পাঠ করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখতে পারবেন-
‘কি খেয়ে মাতাল হওয়ার কথা ছিল
আর কিসে পোড়াচ্ছি মাস-হাড়
কোথাকার রয়েছে হাতে টিকিট
আর কোন গাড়িতে উঠেছি ভ্রমে
তালুর থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে সব
কাটা মুণ্ডুর রক্তচাটে শৃগাল
কার কাছে যাওয়ার কথা ছিল
অথচ জানিনা চলেছি কোথায়?
সেইদিক থেকে বিজ্ঞানপ্রেমী সন্দীপন ধর কবি সমালোচক গল্পকার হিসেবে বাঙালি পাঠকে নিজের স্থান অর্জন করে নিলেও ফেসবুকে কখনোই কবিতা পোস্ট করেননা। কিন্তু কিছু ছোটগল্প পড়েছি উনার ওয়াল ও অন্যান্য সোসাল মিডিয়ায়। প্রত্যেকটি গল্পেই তিনি সহজ সরল ভাষায় মানুষের ব্যথা বেদনাকে তুলে ধরেছেন। সুদূর বরাকভ্যালি থেকে তিনি লেখেন। ফেসবুকের দৌলতে এতটা দূরে থেকেও আমরা পেয়ে যাই বিজ্ঞানমনস্ক এই লেখকের সৃষ্টিকর্ম। গতবছর লকডাউন যখন শুরু হয় সেই সময় গভীর রাতে সন্দীপন ধর পোস্ট করেছিলেন কোভিড সংক্রান্ত প্রবন্ধ- ‘ভাইরাল ভাইরাস’। সেই রাত্রেই আমি প্রবন্ধটি পড়েছিলাম। জানতে পেরেছিলাম কোভিডের খুঁটিনাটি। শুধু তাই নয় ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস, ইবোলা প্রভৃতি আরো অনেক বিষয়ে তিনি সেই ফেসবুক প্রবন্ধে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু মজার বিষয় হল- লকডাউন পিরিওডে বেশীরভাগ সময় যখন অনলাইনেই কাটতো সেই সময় অনেক জায়গায় দেখেছি প্রাবন্ধিক সন্দীপন ধরের প্রবন্ধের বিশেষ বিশেষ অংশগুলো অনেকেই নিজদের নামে সোসালমিডিয়ায় প্রচার করছে।প্রাবন্ধিককে আমি তখন চিনতাম না।অনেকদিন পর প্রাবন্ধিকের সাথে পরিচয় হলে ‘ভাইওরাল ভাইরাস’ প্রবন্ধ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। প্রবন্ধের অংশ বিশেষ অনেকেই অন্যের নামে নিজেদের ওয়ালে পোস্ট করার বিষয়টি তুলে ধরতেই একগাল হেসে বললেন-‘সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানকর্মীর কাজই তো সত্যকথা তুলে ধরা। সত্য কথাই তো সমাজে ছড়ানো উচিত। সেই সত্য কথাকে কেউ যদি নিজের নামেই চালায় তবুওতো সমাজ উপকৃত হয়।প্রবন্ধের গ্রহণযোগ্যতা ছিল বলেই তো টুকরো টুকরো অংশ হলেও অনেকে নিজের নামে প্রচার করেছে এবং লোকে পড়ে কোভিডের ভয়াবহতা সম্বন্ধে সচেতন হয়েছে। এখানেই তো বিজ্ঞানকর্মী হিসেবে প্রত্যেকটি সমাজকর্মীর সার্থকতা’। আমি চুপচাপ শুনছিলাম উনার বক্তব্য। উনার মুখেই প্রথম শুনেছিলাম- ‘ভালো জিনিস চুরি হয়, মন্দ জিনিস চুরি হয়না। লেখা চুরি হওয়ার ভয়ে ফেসবুকে যারা লিখতে ভয় পান,তাদের দ্বারা সমাজ উপকৃত হতে পারেনা’।প্রাবন্ধিকের ‘বনসাঁই’ ও ‘ভয়’ প্রভৃতি বইগুলি পড়লে সমাজের প্রতি প্রাবন্ধিকের দায়বদ্ধতা, কর্মনিষ্ঠা আরও সুন্দরভাবে জানা যাবে।
ভ্রমণ পিপাসু নীলাঞ্জন মিস্ত্রী পেশায় স্কুল শিক্ষক হলেও ফেসবুকে ভ্রমণবিষক লেখা লিখেই সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নে মশগুল। উনার ফেসবুক ওয়াল ও অন্যান্য কয়েকটি গ্রুপে প্রায় দিন-ই কিছুনা কিছু নতুন বিষয়ক লেখা ফুটে উঠে।তরাই-ডুয়ার্সের এমন কোন জায়গা নেই- যে স্থান নিয়ে তিনি লেখেননি। ধারাবাহিক ভাবে ‘পরবাস’ থেকে লিখছি’ পাঠ করেই কতমানুষ যে তিস্তার চরে ঘুরতে গেছে তার হিসেব নাই। ‘সহজ উঠোন’ ফেসবুক গ্রুপে গবেষণামূলক রচনা ‘তিস্তাবাথান’ প্রথম দিকের কিছু পর্ব পাঠ করে কেউ কেউ ব্যঙ্গাত্বক কমেণ্ট করলেও লেখকের উদ্দেশ্যের বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি।বর্তমানে তো ‘তিস্তাবাথান’ পাঠের জন্য একটা বড় অংশের পাঠক অপেক্ষা করে থাকেন। শুধু তাই নয় এর থেকেও কিছু ভালো অপেক্ষা করছে বলে শুনছি। ভ্রমণ পাগল ফেসবুকের বাইকাল ভাইকে অভিনন্দন। তবে বাইকাল ভাইয়ের ‘পরবাস থেকে লিখছি’ ও ‘তিস্তাবাথান’ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে ফেসবুকেই কয়েকজন অন্যান্য বিষয় লিখছেন বলে চোখে পড়ছে। তারা কৃতজ্ঞতাটুকু স্বীকার করেননি।এবিষয়েও সন্দীপন ধর মহাশয় উল্লেখ করেছিলেন-‘সরাসরি লেখা চুরি হোক, কিন্তু অন্যের লেখা থেকে উপাদান নিয়ে নতুন করে লিখতে গিয়ে যারা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেননা, তারা নরকের কীটের থেকেও অধম’।
গবেষক অরূপ মজুমদার ভবঘুরে লোক। আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঙ্গনে নিয়ে আসাই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রত্যেকটি জেলাতেই উনার অগাধ বিচরণ।নিজের নামে ফেসবুক একাউণ্ট থাকলেও কখনোই কিছু পোস্ট করেন না।কিন্তু বিভিন্ন পোর্টালগুলিতে নিজের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার্থীদের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন ধরণের লেখা তিনি লিখেই চলছেন। পোর্টালের এডমিনবাবুরাও অপেক্ষায় থাকেন অরূপ মজুমদার কখন উপসম্পাদকীয়’র জন্য কলম ধরবেন। মূলত পোর্টালে প্রবন্ধ লিখেই উনি বিরাট সংখ্যক শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন।পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত প্রায় ২০টি জনজাতিদের নিয়ে এপর্যন্ত অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি।এইরকম ভবঘুরে ভাষা ও জনজাতি প্রেমী ফেসবুক প্রাবন্ধিক খুব কমই আছেন।নির্মাণ করেছেন আদিবাসী ভাষা বিষয়ক কয়েকটি বই।
একদম মফঃস্বল থেকে ফেসবুকে কবিতা লিখে চিত্তরঞ্জন মণ্ডল ও শিশির কুমার রায় কবি হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়েছেন। কবি চিত্তরঞ্জন মণ্ডল ছন্দাকারে প্রেমবিষয়ক কবিতা লিখলেও শিশিরবাবু আধ্যাত্মবিষয়ক কবিতা লিখেই প্রতিষ্ঠিত। সবটাই হয়েছে ফেসবুকের জন্য। কবি চিতত্তরঞ্জন মণ্ডলের ‘একাদশীর চাঁদের আলোয়’ কাব্যগ্রন্থটি বিভিন্ন বইমেলায় যেমন সুনামের সাথে বিক্রি হয়েছে তেমনি শিশির রায়ের ‘চলো খুঁজি তাঁরে’ আধ্যাত্মমূলক বই হিসেবে আত্মপ্রকাশ হতে চলেছে। ফেসবুকের ব্যবহার না হলে আমরা এই কবিদ্বয়কে পেতামনা।ধীরাজ রায় একজন চিত্রশিল্পী। কিন্তু তাঁর ফেসবুকের ওয়াল অসংখ্য প্রশংসিত কবিতা দিয়ে ভরা।কবিতার শৈলি নিয়ে এই কবি নাড়াচাড়া করেন। তাই প্রত্যেকটি কবিতার ভাষাতেও দেখা যায় স্বতন্ত্রতা। শিশির রায়নাথ এর লেখা পড়ে উনাকে একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক হিসেবেই মনে হয়। ‘সহজ উঠোন’ ফেসবুক গ্রুপে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ‘বাগানিয়া জার্নাল’। তরাই-ডুয়ার্স ও আসামে চা-বানের ইতিহাস জীবন্ত হয়ে ধরা পড়ছে উনার রচনায়। ‘বাগানিয়া জার্নাল’ ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে চা-পরিচর্যা ও বাগান বিষয়ক দলিল হিসেবে দেখা দেবে এবিষয়ে সন্দেহ নেই। ‘সহজ উঠোনে’ই সুকান্ত নাহা’র ‘চা-ডুবুরি’তে প্রতিফলিত হচ্ছে নীলপাহাড়ি’র সুখ-দুঃখ-হাসি-হাসি-কান্নার কথা।কুবেরের কপালে যেমন সুখ হয়নি তেমনি ‘চা-ডুবুরি’র’ জোহান নকুল মিস্ত্রীদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। শিশির রায়নাথ ও সুকান্ত নাহা এই দুইজন ধারাবাহিকের মাধ্যমে চা বাগানের সাহিত্যকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন- সেবিষয়ে সন্দেহ নাই। দু’জনের হাতেই লেখা আছে ভাব আছে ভাষা আছে।
গৌহাটি থেকে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ফেসবুকে নিয়মিত কবিতা লেখেন। উনার কবিতায় আসামের কথা উঠে আসে, ডিটেনশন ক্যাম্পের কথা উঠে আসে। তেজপুর থেকে ডিব্রুগড়ের সাথেও পরিচয় হবে উনার লেখা পড়লে।উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা লিটল ম্যাগাজিন প্রসারণেও উনার উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো। রাঢ়বঙ্গের বিদ্যুৎ মিশ্র একজন প্রতিষ্ঠিত কবি। মূলত শিশুদের জন্য ফেসবুকে ছড়া জাতীয় লেখা লেখেন।শুধুমাত্র উনার ছড়া যদি কোন পাঠক অনুসরণ করেন তবে নিজের সন্তান সন্ততিকেও অনেক কিছু শেখাতে পারবেন বলে আমার মনে হয়।
যাইহোক, আমি ফেসবুক অনুসরণ করি, শেখ সোলেইমান, দেব গৌতম ও অনিমেষ রায়ের গান শুনি। সেই সাথে নব্য ও প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিকদের লেখা পড়ে কমেণ্ট করার চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যক্তিগত পরিচয় খুবই কম। বহির্বঙ্গে অবস্থান করলে যা হয়। ফেসবুকে যারা লিখছেন; নিয়মিত লিখুন। বাংলাভাষার প্রসারে লিখুন।মাতৃভাষা রক্ষার্থে লিখুন। ভাষাকে ছড়িয়ে দিন দেশে বিদেশে। সোস্যালমিডিয়া সেই প্ল্যাটফর্ম।টেকনোলজির যুগ, তাই ল্যাঙ্গুয়েজ টেকনলজির উন্নতকল্পে সোসালমিডিয়াই মূল হাতিয়ার। উইকিপিডিয়ায় বাংলা বিষয়ক সমস্ত তথ্যের জন্য আমরা আপনারা লিখলেই হবে। এর জন্য অন্য কারো দরকার নেই। প্রত্যেকটি লেখাই একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছালে অটোমেটিক গুগলে সেভ হয়ে যাবে। তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মও ঘরে বসেই বাংলাবিষয়ক সমস্ত তথ্য ঘরে বসেই পেয়ে যাবে।
No comments:
Post a Comment