আমার নজরুল
-- স্বপনকুমার ঘোষ
" সুমতি কুঞ্জ "
(বারাণসী/কোলকাতা)
কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে কবি - ঔপন্যাসিক - প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু নাকি বলেছিলেন --' His best songs are his best poems
' ।
নজরুল স্বয়ং লিখেছিলেন -- ' আনন্দ - রসঘন স্বর্ণবর্ণেরএক না - জানা আকাশ থেকে যে শক্তি আমায় রস সরবরাহ করতেন -- আগেই বলেছি , তিনি মহাশ্বেতা - রূপে মাঝে - মাঝে হয়ে যান সমাধিস্থা । * আমার সেই আনন্দময়ী শক্তি যদি আবার সমাধিস্থা না হন , আমায় পরম শূন্যে নিয়ে গিয়ে চিরকালের জন্য লয় না করেন , তাহলে এই পৃথিবীতে যে প্রেমের যে সাম্যের যে আনন্দের গান গেয়ে যাব -- সে গান পৃথিবী বহুকাল শোনেনি । '
কবির চিরশ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথ , নিজের ' অগ্নিবীণা ' কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে নজরুল যাঁর উদ্দেশে লিখেছিলেন --
'
বিশ্বকবিসম্রাট
শ্রীল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু '
-- তিনিও এই ধারণা নিজের সম্পর্কে পোষণ করতেন যে -- তাঁর অন্য রচনা থাক বা না থাক , তাঁর গান থেকে যাবে ।
আমাদেরও মনোভাব , নজরুলের বাণীতেই --
' সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে
তুমি
আমারে ছুঁইয়াছিলে । *'
সুর ও বাণীর এই মালা তিনি রচনা করেছিলেন বিভিন্ন ভাবের পুষ্প চয়ন ক'রে । তার মধ্যে যেমন রয়েছে উদ্দীপক দেশাত্মবোধের -- উজ্জ্বল সূর্যমুখী ; ভক্তির -- শান্ত - শুভ্র টগর দোপাটি , বর্ণোজ্জ্বল নয়নতারা , রাঙা জবা , সুনীল অপরাজিতা , বাসন্তী অতসী ; হাসির -- গাঁদা আর লোক - আঙ্গিকের -- পলাশ - শিমুল * তেমনই রয়েছে প্রেম -
প্রণয় - ভালোবাসার -- গোলাপ - চাঁপা - শালুক - পদ্ম - মহুয়া * ।
একদা ' মিত্র ও ঘোষ ' প্রকাশন ' ঐকতান ' নামে একটি তন্বী ( ৬২ পৃষ্ঠার ) প্রেমের কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছিলেন । অসাধারণ সে সংকলন । তার একটি অসামান্য ' ভূমিকা ' লিখে দিয়েছিলেন সাহিত্যিক - অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী । তাতে তিনি বলেছেন --
' বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অংশ কবিতা , সে কবিতাও আবার রোমান্টিক । রোমান্টিক শব্দটাকে সঙ্কীর্ণভাবে গ্রহণ না করলে দেখা যাবে যে পৃথিবীর যাবতীয় শ্রেষ্ঠ কাব্য কবিতা রোমান্টিক । অন্য শ্রেণীর কাব্য কবিতা অক্ষমের অহমিকা ছাড়া কিছুই নয় ।* '
অনুরূপ মত আমরাও বহুলাংশে পোষণ করি । আমরা তাই এই মূহূর্তে তাঁর ভালোবাসার গানগুলির কথা বলতে চাই ।
চিরাভ্যস্ত মানব - মানবীর প্রেম , শাশ্বত ভারতীয় ভাবধারায় হরগৌরীর দাম্পত্যপ্রণয় বা রাধাকৃষ্ণের পারিবারিক গণ্ডিছাপানো প্রণয়লীলা নজরুলের রচনায় এসেছে বটে , যেমন এসেছে অন্য কবির রচনায় , কিন্তু এই সবের পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন এইজাতীয়ই এমন কিছু গান , যাকে এককথায় অভিনব বলা চলে । কারণ --
' প্রেম ' সাধারণতঃ -- উভয়পক্ষীয় । কিন্তু এই গানগুলিতে যে আকর্ষণ , তা একপক্ষীয় । তাই একে ' প্রেম ' না ব'লে ' মুগ্ধতা ' বলতেই ভালোবাসবো আমরা । যাকে নিয়ে মুগ্ধতা , সে এই মুগ্ধতার কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিন্দুবিসর্গও জানলো না এবং যে মুগ্ধ হলো , সেও শুধু তার মাধুর্যকেই অনুভব করলো । ক'রে -- ' আপন সুরে আপনি নিমগন ' -- হলো । হলো রসসমৃদ্ধ , ধন্য ।
এবং এই পর্যায়ের গান বা কবিতার চমৎকারিত্ব এই যে এই মুগ্ধতার শতদলটি যাকে / যাদেরকে কেন্দ্র ক'রে ফুটে উঠলো , সে বা তারা কিন্তু তরুণী , যুবতী বা মধ্যযৌবনা নয় । হয় -- কিশোরী , নয় -- বালিকা !
স্বল্প পরিসরে , ' বিন্দুতে সিন্ধু '-র স্বাদ পেতে আমরা আমাদের আলাপ আপাততঃ এই পরিসরটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছি ।
প্রথমেই উৎসুক রসপিপাসু পাঠক - পাঠিকাকে আমন্ত্রণ জানাই নজরুলের -- ' পূবের হাওয়া '(১৩৬৪ সংস্করণ , ষ্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স; ৫ , শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট , কোলকাতা- ১২) -- কাব্যগ্রন্থের আঙিনায়। সেখান থেকে বেছে নিই চারটি কবিতা ।
' যাস কোথা সই একলা ও তুই
অলস বৈশাখে ?
জল নিতে যে যাবি ওলো
কলস কই কাঁখে ?
সাঁজ ভেবে তুই ভর দুপুরেই
দুকূল নাচায়ে
পুকুর পানে ঝুমুর ঝুমুর
নূপুর বাজায়ে
যাসনে একা হাবা ছুঁড়ি
অফুট জবা চাঁপা কুঁড়ি তুই !
* * * * * * *
পাগলী মেয়ে ! রাগলি নাকি?
ছি ছি দুপুর-কালে
কেমনে দিবি সরস অধর-পরশ সই তাকে ? '
('দুপুর অভিসার ', পৃ:২৪)
' লো কিশোরী কুমারী !
পিয়াসী মন তোমার ঠোঁটের
একটি গোপন চুমারি ।।
অফুট তোমার অধর ফুলে
কাঁপন যখন নাচন তুলে
একটু চাওয়ায়
একটু ছুঁলে গো !
তখন এ মন যেমন
কেমন - কেমন
কোন তিয়াষে কোঙারি ?
* * * * * * *
আমার কুমার হিয়া মুক্তি মাগে
অধর ছোঁয়ায় তোমারি ।। '
(' প্রণয় নিবেদন ',পৃ: ৩৭)
'তখন মোদের কিশোর বয়েস
যেদিন হঠাৎ টুটলো বাঁধন ,
সেই হতে কার বিদায় - বেণুর
জগৎ - জোড়া শুনছি কাঁদন !
সেই কিশোরীর হারা - মায়া
ভুবন ভরে নিল কায়া ,
দুলে আজো তারি ছায়া
আমার সকল পথে আসি ।।'
( ' বিদায় বাঁশী ', পৃ: ৪৩ )
এই তিনটি কবিতাতেই মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে কিশোর হৃদয়ের এবং যে কিশোরী/দের উদ্দেশে তা উচ্চারিত , তারা সম্ভবতঃ এই কিশোর বা / এবং তার মনোভাব সম্পর্কে অনবহিত ।
কিন্তু চতুর্থ কবিতা -- ' প্রণয় - ছল '(পৃ: ৪০) -- ভিন্নতর । এ কবিতায় প্রণয় - আকর্ষণ এক কিশোরী - হৃদয়ের । সে আকর্ষণ কিন্তু অপর পক্ষের কাছে অজ্ঞাত নয় । কারণ -- ভাবে , ভঙ্গিতে বিভিন্ন প্রকার চেষ্টিত অবলম্বনে তাকে ব্যক্ত করাই প্রণয়াকাঙ্ক্ষিনীর কাঙ্ক্ষিত ।
' কত ছল করে সে বারে বারে
দেখতে আসে আমায় ।
কত বিনা-কাজের
কাজের ছলে
চরণ দুটি
আমার দোরেই থামায় ।।
জানলা আড়ে চিকের পাশে
দাঁড়ায় এসে কিসের আশে ,
আমায় দেখেই সলাজ ত্রাসে ,
গাল দুটিকে ঘামায় ।।
অনামিকায় জড়িয়ে আঁচল
দুরু দুরু বুকে
সবাই যখন ঘুমে মগন
তখন আমায় চুপে চুপে
দেখতে এসেই মল বাজিয়ে
দৌড়ে পলায় রঙ খেলিয়ে
চিবুক গালের কূপে
দোর দিয়ে মোর জলকে চলে
কাঁকন মারে কলস - গলে ,
অমনি চোখাচোখি হলে
চমকে ভুঁয়ে নখটি ফোটায়
চোখ দুটিকে নামায়।। *'
এইবার গানের পালা ।
আমরা তিনটি গান চয়ন করেছি । ' সাহিত্যম্ '( ১৮বি শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট , কোল -৭৩) প্রকাশনীর ' সুনির্বাচিত নজরুলগীতির স্বরলিপি ( প্রথম খণ্ড ; প্রথম প্রকাশ : মহালয়া ১৩৮২) থেকে ।
প্রথম গানটি( পৃ: ২১১)--
' চ'মকে চমকে ধীর ভীরু পায়
পল্লী - বালিকা বন পথে যায়
একেলা বন পথে যায় ।।
** '
এ বালিকা সম্পূর্ণ অনবহিত -- তার স্ফুটনোন্মুখ রূপমাধুর্য কারো নয়নে মায়াঞ্জন পরিয়ে দিয়ে থাকে তার অজানতে । তার অনবধানতা তাই অধিকন্তু আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ।
এই গীত ও কবিতা সপ্তকের মধ্যে, এমনকি এবংবিধ সমগ্র নজরুল রচনার মধ্যে যে দুটিতে কবির প্রতিভা তার চরমতম উৎকর্ষে পৌঁছেছে , তার একটি হলো এই গানটি ( চুরাশী সংখ্যক, পৃ:২১৪):--
' ভোরে ঝিলের জলে
শালুক পদ্ম তোলে কে
ভ্রমরকুন্তলা কিশোরী ।
ফুল দেখে বেভুল
সিনান বিসরি ।।
একি নূতন লীলা
আঁখিতে দেখি ভুল
কমল ফুল যেন
তোলে কমল ফুল
ভাসায়ে আকাশ- গাঙে
অরুণ - গাগরি ।।
ঝিলের নিথর জলে
আবেশে ঢলঢল
গ'লে পড়ে শত সে তরঙ্গে ,
শারদ আকাশে
দলে দলে আসে
মেঘ বলাকার খেলিতে সঙ্গে ।
আলোকমঞ্জরী প্রভাত বেলা
বিকশি ' জলে কি গো
করিছে খেলা
বুকের আঁচলে ফুল
উঠিছে শিহরি ।। '
দ্বিতীয় গানটি ( একুশ সংখ্যক , পৃ: ৭১ ) :--
' কাবেরী নদীজলে
কে গো বালিকা
আনমনে ভাসাও
চম্পা শেফালিকা
প্রভাত সিনানে আসি অলসে
কঙ্কণ তাল হানো কলসে ,
খেলে সমীরণ ল'য়ে
করবীর মালিকা ।
দিনান্তে অনুরাগে
নবারুণ জাগে
তব জল ঢল ঢল
করুণা মাগে ।
ঝিলম্ রেবা নদীতীরে
মেঘদূত বুঝি খুঁজে ফিরে
তোমারেই তন্বী শ্যামা
কর্ণাটিকা ।। '
শুধুমাত্র নজরুলের নিজের সৃষ্টির জগতে নয় , অন্য যে কোনো বা যাবতীয় কবির এই আঙ্গিকের সৃষ্টিসমূহের আকাশে এই গান দুটি চন্দ্র - সূর্যের দীপ্তিতে দীপ্তিমান -- এই আলোচকের উপলব্ধি এমনই । কী চিত্রকল্প !! সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে ।
তদ্গতচিত্ত পাঠক -পাঠিকা ! লক্ষ্য করুন -- এই দুটি গানের আশ্চর্য একরূপতা ! একটিতে -- ঝিলের জলে , অন্যটিতে -- নদীর জলে -- স্নানে নেমে যথাক্রমে কিশোরী ও বালিকা যথাক্রমে --' শালুক পদ্ম তোলে ' -- ও --' চম্পা - শেফালিকা ' -- ভাসায় । * আরো একটি বিশেষ লক্ষ্যণীয় -- দ্বিতীয় গানটির পটভূমি কিন্তু বঙ্গভূমি নয়, কর্ণাটক ! যার জন্য ঐ মেয়ে -- ' তন্বী শ্যামা কর্ণাটিকা ' । এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল কিভাবে ? খেয়াল ক'রে দেখুন -- বালিকা স্নানে নেমেছে যে নদীতে , সে নদী --' কাবেরী ' । যা প্রবাহিত কর্ণাটক প্রদেশে ।
যে কোনো কবি , গীতিকার , সুরকার -- এমন দুটি গান রচনা করতে পারলে ধন্য হয়ে যেতেন । এ গান পরিবেশনও যে কোনো গায়কের কণ্ঠে -- ' পরমপ্রাপ্তি ' -- হয়ে উঠবে না । মরমী পাঠক - পাঠিকা - শ্রোতা - শ্রোত্রী !! স্বর্গীয় শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় -এর কণ্ঠে --' ভোরের ঝিলের জলে '-- এবং স্বর্গীয়া শিল্পী সুপ্রভা সরকার -এর কণ্ঠে --' কাবেরী নদী জলে '-- শুনলেই এ কথা উপলব্ধি করবেন ।
কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র -এর উচ্চারণ ( ' সাগর থেকে ফেরা ' কাব্যগ্রন্থে ঐ নামীয় কবিতায় )--' শূন্যের আনমনা হাসির সামিল '-- এই গানদুটি প্রসঙ্গে একশত ভাগ প্রযোজ্য ।।
আনন্দিত হলাম । প্রথমতঃ ,' সংবাদ একলব্য ' আমায় সাদরে বরণ ক'রে নেওয়ায় । দ্বিতীয়তঃ , আমার রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বিষয়ক রচনা পর পর তার পাঠকদের উপহার দেওয়ায় । আমাদের সুসম্পর্ক বজায় থাকুক । আর -- আমাদের এই সেতুবন্ধন যার দরুণ সম্ভব হলো, সেই শ্রীমান সঞ্জীবন মণ্ডল-এর প্রতি রইলো কৃতজ্ঞতা ।।
ReplyDelete