Latest Bengali News Portal

Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

Thursday, May 20, 2021

রবীন্দ্রনাথ এবং কাশী





রবীন্দ্রনাথ এবং কাশী
স্বপনকুমার ঘোষ

( ১ )

মানবসভ্যতার আদি যুগ থেকে কাশী আকর্ষণ ক'রে এসেছে -- শ্রদ্ধা , ভালোবাসা । সাধারণ - অসাধারণ -- সবার চৈতন্যে ঢেউ তুলেছে কাশী । রবীন্দ্রমননেও দেখি -- কাশীর মহিমময় প্রতিচ্ছবি । তিনি লেখেন -- ' * বিদেশীর ইতিহাসে * ঘরের কথা কিছুমাত্র পাই না । সেই ইতিহাস পড়িলে মনে হয় , ভারতবর্ষ তখন ছিল না , কেবল মোগল - পাঠানের গর্জনমুখর বাত্যাবর্ত শুষ্কপত্রের ধ্বজা তুলিয়া উত্তর হ‌ইতে দক্ষিণে এবং পশ্চিম হ‌ইতে পূর্বে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল ।

কিন্তু বিদেশ যখন ছিল দেশ তখনো ছিল , নহিলে এই - সমস্ত উপদ্রবের মধ্যে কবীর নানক চৈতন্য তুকারাম ইঁহাদিগকে জন্ম দিল কে ? তখন যে কেবল দিল্লি এবং আগ্রা ছিল তাহা নহে , কাশী এবং নবদ্বীপ‌ও ছিল । তখন প্রকৃত ভারতবর্ষের মধ্যে যে জীবনস্রোত বহিতেছিল , যে চেষ্টার তরঙ্গ উঠিতেছিল , যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটিতেছিল , তাহার বিবরণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না । '

[' ভারতবর্ষের ইতিহাস ' -- রবীন্দ্র রচনাবলী ( সুলভ) দ্বিতীয় খণ্ড , পৃ:৭০৪;১২৫তম রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত সুলভ সংস্করণ , বিশ্বভারতী ]



তাঁর রচনায় , তাঁর চিঠিপত্রে , কাশীর উল্লেখ দৃষ্টি আকর্ষণ করে । ' ব‌উ - ঠাকুরাণীর হাট ' উপন্যাসে --

' বিভা উদয়াদিত্যের সহিত কাশী চলিয়া গেল । সেইখানে দানধ্যান , দেবসেবা ও তাহার ভ্রাতার সেবায় জীবন কাটাইতে লাগিল । রামমোহন যতদিন বাঁচিয়াছিল , তাহাদের সঙ্গে ছিল । সীতারাম ও সপরিবারে কাশীতে আসিয়া উদয়াদিত্যের আশ্রয় ল‌ইল ।' ( ঐ রচনাবলী , প্রথম খণ্ড , পৃ: ৬৯৮)

এইভাবেই ' করুণা ' গল্পের অন্যতম প্রধান দুই নারীচরিত্র -- করুণা ও মোহিনীও ( সু - রচনাবলী , চতুর্দশ খণ্ড , পৃ: ১১৮, ১২২ , ১২৬ , ১২৭ ) গল্পের শেষে কাশীবাসিনী । কাশীতে বসবাস , অন্য স্থান থেকে বাংলায় যাতায়াতের সময় কাশীতে পথিমধ্যে অবতরণ -- এসব এ কাহিনীতে আছে ।

' কথা ' কাব্যগ্রন্থের ' মস্তকবিক্রয় ' কবিতায় দেখা পাই কোশল ও কাশীরাজের । ( ঐ রচনাবলী , চতুর্থ খণ্ড , পৃ: ২৬ ।) ঐ কাব্যগ্রন্থেরই

' সামান্য ক্ষতি ' কবিতার পটভূমি কাশী ; প্রধান দুই চরিত্র -- কাশীরাজ ও ' কাশীর মহিষী করুণা ' । ( পৃ: ৪১ ।)

' ছড়ার ছবি ' কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা --' কাশী '। ( সু - রচনাবলী , একাদশ খণ্ড , পৃ: ৭৯ ।) এর পটভূমি -- কাশী । এমনকি কাশীর রাজধানী বারাণসীর অন্তর্গত

' অগস্ত্যকুণ্ড ' অঞ্চলের নাম‌ও পাওয়া যায় ।

' কাশীর গল্প শুনেছিলুম

যোগীনদাদার কাছে ,

পষ্ট মনে আছে ।*

কোথায় তোমার খুড়ির বাসা

অগস্তকুণ্ডে কি ,

যে ক'রে হোকআজকে রাতেই

খুঁজে একবার দেখি * '

প্রসঙ্গতঃ , বর্তমান আলোচকের জন্মস্থান-- ঐ অগস্ত্যকুণ্ড ।

শেষ বয়সে কাশীতে ' ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এ্য‌াসোসিয়েশন'- এর সভায় রবীন্দ্রনাথ সভাসীন । এই আলোচকের পিতৃদেব স্বর্গীয় কুঞ্জবিহারী ঘোষ‌ও সেই সভায় সমাসীন । স্বর্গীয় পিতৃদেব কবিকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর --' তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী '-- গানখানি পরিবেশন করতে । কবি ইষৎ উদাসীনভাবে বলেছিলেন -- এখন কি আর তেমন গাইতে পারি ! ** কিন্তু অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন ।

বারাণসী থেকে অর্ধশতাব্দীব্যাপী কালসীমার পরিধি জুড়ে প্রকাশিত হতো বাংলা সাহিত্যপত্রিকা -- ' উত্তরা ' । সুঅধীতী সাহিত্যপথিকমাত্রেই অবগত আছেন যে একসময় সাহিত্যপত্রিকার জগতে তিনটি নাম উচ্চারিত হতো একসঙ্গে , একনিঃশ্বাসে --' উত্তরা ' -' কল্লোল '- ' কালি - কলম ' *। এই ' উত্তরা '-র

নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে ছিলেন -- স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ । তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ' ছন্দ '( সু - রচনাবলী , একাদশ খণ্ড , পৃ:৫৪৬)- তে উল্লেখ পাই 'উত্তরা'-র :--' দিলীপকুমার আশ্বিনের ' উত্তরা '-য় ছন্দ সম্বন্ধে আমার দুই - একটি চিঠির খণ্ড ছাপিয়েছেন ।'

প্রসঙ্গতঃ , ' উত্তরা '-র শ্রুতকীর্ত্তি সম্পাদক স্বর্গীয় সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী-র সঙ্গে নিবিড় স্নেহসম্পর্ক ছিলো রবীন্দ্রনাথের । কাশীর তৎকালীন সাহিত্যবিদ - সাহিত্যিক - সমালোচক রামকুণ্ড- নিবাসী স্বর্গীয় কেদার মুখোপাধ্যায় - এর মুখে এই আলোচক স্বকর্ণে শুনেছে -- ' রবীন্দ্রনাথ যে কেদারায় বসতেন , একমাত্র সুরেশদারই অধিকার ছিলো তাঁর কাছে গিয়ে সেই কেদারার হাতলে বসার *'।

যে সময় বিদ্যাসাগর মশাইয়ের পিতৃদেব ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতৃদেবী ভগবতী দেবী কাশীবাস করছিলেন ,সে সময় বিদ্যাসাগর তা‍ঁদের দর্শন করতে কাশী যেতেন । সে কথা রবীন্দ্রনাথের ' চারিত্রপূজা ' গ্রন্থের ' বিদ্যাসাগর চরিত ' প্রবন্ধে আছে ।( সু- রচনাবলী , দ্বিতীয় খণ্ড , পৃ: ৭৮১ )

' প্রথম দর্শনে প্রেম ' বলতে যা বোঝায় , কাশীতে প্রথম আগমনের সময়েই সে অনুভূতি রবীন্দ্রনাথের হয়েছিলো । এমনকি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুভাবনা --' মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান '-এর ধ্রুবপদটি রচনাতেও অনুরণন তুলেছে সম্ভবতঃ এই প্রথম সাক্ষাতের অনুভূতি । ১৯২৫ খৃষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারী , আমেরিকার পেরু রাজ্যের শতবার্ষিক উৎসবে যোগদান অন্তে দেশে ফেরার সময় ' ক্রাকোভিয়া ' জাহাজ -এর কক্ষে যে লেখা তিনি লিখেছিলেন , তার প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধার করলে এ ধারণার সমর্থন পাওয়া যেতে পারবে --

" বহুকাল হল আমি যখন প্রথম কাশীতে গিয়েছিলাম তখন মৃত্যুকালের যে - একটি মনোহর দৃশ্য চোখে পড়েছিল , তা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না । ঠিক মনে নেই , বোধ করি তখন শরৎকাল ; নির্মল আকাশ থেকে প্রভাতসূর্য জীবধাত্রী বসুন্ধরা-কে আলোকে অভিষিক্ত করে দিয়েছে । এপারের লোকালয়ের বিচিত্র চাঞ্চল্য , ওপারের প্রান্তরের সুদূরবিস্তীর্ণ নিস্তব্ধতা , মাঝখানে জলধারা সমস্তকে দেবতার পরশমণি ছোঁয়ানো হল । নদীর ঠিক মাঝখানে দেখি একটি ডিঙি নৌকা খরস্রোতে ছুটে চলেছে । আকাশের দিকে মুখ করে মুমূর্ষু স্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে , তার‌ই মাথার কাছে করতাল বাজিয়ে উচ্চস্বরে কীর্তন চলছে । নিখিল বিশ্বের বক্ষের মাঝে মৃত্যুর যে - পরম আহ্বান , আমার কাছে তার‌ই সুগম্ভীর সুরে আকাশ পূর্ণ হয়ে উঠল । যেখানে তার আসন , সেখানে তার শান্তরূপ দেখতে পেলে মৃত্যু যে কত সুন্দর , তা স্পষ্ট প্রত্যক্ষ হয় ।* মৃত্যু বাঁধন ছিন্ন করে দেবে , এইটেই কুৎসিত । আপনি বাঁধন আলগা করে দিয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে তার হাত ধরব , এইটেই সুন্দর ।

হিন্দু কাশীকে পৃথিবীর বাহিরের স্থান বলেই বিশ্বাস করে । তার কাছে কাশীর ভৌগোলিক সীমানা একটা মায়া , পরমার্থত সেখানে নিখিল বিশ্বের পরিচয় , সেখানে বিশ্বেশ্বরের আসন । অত‌এব , বিশেষ দেশবাসীর কাছে বিশেষ দেশের যে আকর্ষণবেগ তার প্রাণকে সেখানকার মাটি জল আকাশের সঙ্গে নানা বিশেষ সূত্রে বাঁধে , কাশীর মধ্যে যেন পৃথিবীর সেই বিশেষ দেশগত বন্ধন‌ও নেই । অত‌এব , যথার্থ হিন্দুর কানে মৃত্যুর মুক্তিবাণী কাশীতে বিশুদ্ধ সুরে প্রবেশ করে । * '


এই ভাবনার অভিঘাত তাঁকে এমন ক'রেই অভিভূত , আপ্লুত করেছিলো , তিনি স্বয়ং মৃত্যুকে বরণের আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন কাশীতে , ঐ সময় থেকেই , এই অবিমুক্ত ক্ষেত্রে --

' * সেদিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মনে হল , আমিও যেন মুক্তির তীর্থক্ষেত্রে মরতে পারি ; শেষ মুহূর্তে যেন বলতে পারি , সকল দেশই আমার এক দেশ , সর্বত্র‌ই এক বিশ্বেশ্বরের মন্দির , সকল দেশের মধ্য দিয়েই এক মানবপ্রাণের পবিত্র জাহ্নবীধারা এক মহাসমুদ্রের অভিমুখে নিত্যকাল প্রবাহিত । '

( সু - রচনাবলী, দশম খণ্ড,' যাত্রী ' , পৃ: ৪৮২-৮৩ ।)

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot

Pages