Latest Bengali News Portal

Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

Friday, October 21, 2022

বাংলার পটশিল্প ও পটুয়া সম্প্রদায়

বাংলার পটশিল্প ও পটুয়া সম্প্রদায়


বাংলার পটশিল্প ও পটুয়া সম্প্রদায়





দীপাঞ্জন দে: একদা পাড়া ঘুরে পটুয়া গীত সহযোগে পটচিত্র প্রদর্শন করতে দেখা যেত তাদের। পায়ে হেঁটে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেরিয়ে পট দেখিয়ে, গান শুনিয়ে মানুষের বিনোদন এবং নিজের পরিবারের জন্য অন্ন সংস্থান করতেন তারা। এখানে বাংলার আদিম গণ মনোরঞ্জক ও লোকশিক্ষক পটুয়া সম্প্রদায়ের কথা বলা হচ্ছে। এভাবেই বাংলার পটুয়া সম্প্রদায়কে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতে দেখা যেত। তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে হিন্দু বা মুসলিম যে উপাচার মেনেই চলুন না কেন, তাদের জীবিকা ছিল হিন্দু দেবদেবীর ছবি এঁকে উপার্জন করা। কিন্তু বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া পটুয়ারা সাধারণত আর গ্রামে গ্রামে পট দেখিয়ে বেরান না। আমলাই গ্রামের সেন্টু পটুয়া বা ইটাগড়িয়ার জামির চিত্রকর সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। অধিকাংশ পটুয়াই তাদের পিতৃপুরুষের এই পট দেখিয়ে অন্নভিক্ষার বৃত্তি থেকে সরে এসেছেন। তাই পটুয়া চিত্রকরদের অস্তিত্ব গ্রাম বাংলায় থাকলেও তাদের অধিকাংশই এখন পিতৃপুরুষের জীবিকাচ্যুত। যদিও কিছু পটুয়া পরিবার আছেন যারা অন্নভিক্ষাবৃত্তি ত্যাগ করলেও, পটচিত্র এঁকে এবং সেগুলি বিভিন্ন মেলায় বিপণন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বিগত কয়েক বছরে এই ধরনের পটুয়া শিল্পীদের শিল্পকর্ম বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে।

বাংলার পটশিল্প ও পটুয়া সম্প্রদায়




পটুয়া চিত্রকরদের পটশিল্পে যে পল্লীকলা বিদ্যার পরিস্ফুটন দেখতে পাওয়া যায়, তার প্রশংসা করতেই হয়। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, পটুয়া শিল্পীরা পারিবারিক ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়েই পট আঁকতে শেখেন। পিতৃপুরুষের কাছ থেকে তারা এই বিদ্যা অর্জন করেন। পটের গানের ক্ষেত্রেও একই কথা বলতে হয়। ছোটবেলা থেকে পরিবারের মানুষদের কাছে পটের গান শুনতে শুনতে পটুয়া পরিবারের সন্তানেরা সেই গান কণ্ঠস্থ করে ফেলে। তাই পটুয়াদের গান এবং তাদের আঁকা ছবির নিজস্ব ব্যাকরণ রয়েছে। পটুয়া চিত্রকরদের আঁকা পটচিত্রের ব্যাকরণগত দোষ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা যাক। ভরত চিত্রে রঙ ব্যবহারের নিদেশ দিয়েছিলেন— “শৃঙ্গার -গাঢ় মেটে, প্রফুল্ল ভাব প্রকাশে সাদা, করুণা ভাব প্রকাশের জন্য ধূসর, রৌদ্র-রসে লাল, ভয়ানক ভাব প্রকাশের জন্য কালো। বীভৎস ভাব প্রকাশের জন্য গাঢ় নীল, বিস্ময় প্রকাশের জন্য হলুদ।” কিন্তু চিত্রকররা এই সকল শাস্ত্রীয় রীতিনীতি বহু আগেই ত্যাগ করেছেন। উল্লেখ্য, এই ব্যাকরণগত দোষই তাদের শিল্পকে স্বতন্ত্রতা দিয়েছে। পটুয়াদের আঁকা পটচিত্রে আলোছায়ার ব্যবহার, সুক্ষ্ম কারুকাজ, শিল্পের আভিজাত্য প্রভৃতি প্রায় অনুপস্থিত। তাদের পটচিত্র নতুন চিত্ররীতির দিশারী। তারা যে ঐতিহ্য বিরোধী চিত্র অঙ্কনের জন্য কুপিত ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক অভিশপ্ত হন এবং হিন্দু সমাজচ্যুত হন, সে কথা পুরাণেও রয়েছে—

“ব্যতিক্রমেণ চিত্রাণাং সদ্যশ্চিত্রকবস্তথা।

পতিতে ব্রাহ্ম শাপেন ব্রাহ্মণানঞ্চ কল্পত।।”

বাংলার পটশিল্প ও পটুয়া সম্প্রদায়



আসলে, বাংলার চিত্রকর পটুয়া সম্প্রদায় কখনও কোনও অনুশাসনের অক্টোপাসের বাহুডোরে একভাবে বাঁধিত থাকেনি। এর জন্যই তারা হিন্দু সমাজপতিদের কাছে এবং মুসলিম সমাজপতিদের কাছে অপাংক্তেয় থেকেছে। বহুকাল ধরে এই চিত্রকর সম্প্রদায় বিভিন্ন রকম ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। তাদের জীবন জীবিকা নিয়ে বহু কিংবদন্তি গড়ে উঠেছে। তাদের অনিশ্চিত সামাজিক, ধর্মীয় অবস্থান নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের শিল্প সত্ত্বা ও ধর্মীয় সত্ত্বা বৈপরীত্য অবস্থান নিয়েছে। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের এই প্রাচীন জনজাতির মধ্যে এক সাংস্কৃতিক দোদুল্যমানতার অভিপ্রকাশ ঘটেছে, যা তাদের স্বতন্ত্রতা হলেও একপ্রকার অযাচিত।




বাংলার পটুয়া সম্প্রদায়ের প্রধান পেশা পটচিত্র অঙ্কন করা। তবে বহুকাল ধরেই এরা বিভিন্ন ধরনের জীবিকার সাথেও যুক্ত। পুরুষেরা পশু চিকিৎসা, সানা বাঁধা, সাপ ধরা ও খেলানো, সাপের বিষ, চামড়া প্রভৃতি বিক্রি, মূর্তি তৈরি, পুতুল তৈরি, বাঁদর নাচানো, ফুলের ব্যবসা, চাষবাস, রাজমিস্ত্রি, রঙমিস্ত্রি, তুকতাক করা ইত্যাদি করে থাকে। আর মহিলারা খেজুর পাতা-নারকেল পাতার তালাই বোনে, সানা তৈরি করে, পাড়ায় পাড়ায় মনোহারী দ্রব্য, কাঁচের চুড়ি ফেরি করে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পটুয়া পরিবারের মানুষেরা বহুবিধ জীবিকার সাথে যুক্ত।




খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ট শতক থেকে ভারতবর্ষে পটচিত্র প্রদর্শনী চলত বলে আনুমান করা হয়। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের মতে, এই আদিম শিল্পী দল বহুদিনের প্রচেষ্টায় ছবির জগতে যে কথাটা ধ্রুব সত্য তার সন্ধান পেয়েছিল। পটুয়া ও তাদের পটের ঐতিহ্য প্রাচীন। হিন্দুযুগে যেমন পটের পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি মুসলিম যুগের পটের কথাও জানা যায়। মুঘল যুগের আদিকালে তৈলচিত্র আঁকার রেওয়াজ ছিল না। প্রাচীরে, পুঁথিতে বা পটেই তারা আঁকতেন। পটগুলো গুটিয়ে রাখা হত এবং বিশেষ-বিশেষ সময় সেগুলি খুলে মর্মজ্ঞেরা তার রসাস্বাদন করতেন। এখন বিগত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে অঞ্চল বিশেষে বাংলার কিছু পটুয়া চিত্রকর পুনরায় পটচিত্র এঁকে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সমাজের একশ্রেণীর মানুষ সেই পটচিত্র ক্রয় করছেন। পটুয়ারা তাদের পটচিত্র নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে না বেরিয়ে, বিভিন্ন মেলায় যাচ্ছেন এবং সেখানে দোকান দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে পটুয়া শিল্পীদের এবং তাদের শিল্পমাধ্যমের পরিবর্তন ঘটছে। মনে হচ্ছে যেন পটশিল্প এবং পটুয়া সম্প্রদায়ের এ এক বিবর্তনের পর্যায়।




লেখক: পিএইচডি গবেষক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, নদিয়া।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot

Pages