লক্ষ্মীপুজোর মেলা ঘিরে উন্মাদনা দোগাছি গ্রামে
দীপাঞ্জন দে: কৃষ্ণনগর শহরের অনতিদূরে ‘দোগাছি’ বা ‘দোগাছিয়া’ গ্রাম লক্ষ্মীপুজো এবং ভাসান মেলার জন্য বিখ্যাত। প্রতিবছর এই গ্রামের লক্ষ্মীপুজো এবং মেলা দেখতে বহু মানুষ দোগাছিতে আসেন। গ্রামের নাম ‘দোগাছি’ কেন হল সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। তবে নামটির মধ্যে দুই সংখ্যা এবং গাছ শব্দটি রয়েছে।
দোগাছি গ্রামে চড়কও ভালো হয়। অনেকের মতে, এখানে দুই গাছা বা দুটি চড়ক গাছে চড়ক হত বলে গ্রামের নাম দোগাছি। আবার এও বলা হয় যে, এখানে নাকি একদা একটি বড় বটগাছ এবং একটি বড় অশ্বত্থ গাছ ছিল, সেই থেকেই গ্রামের নাম হয় দোগাছি। উল্লেখ্য, দোগাছি নামের আরো গ্রাম নদিয়া জেলায় রয়েছে। এই দোগাছি বা দোগাছিয়া গ্রামের অন্যতম পরিচয় হল এই গ্রাম দিয়ে অঞ্জনা নদী বয়ে গিয়েছে। অঞ্জনা কৃষ্ণনগরের নগেন্দ্রনগর অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করে কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজ, ক্যাথেড্রাল, বেজিখালি ঢাল হয়ে রাজবাড়ির পাশ দিয়ে এসে শক্তিনগর হয়ে দোগাছি গ্রামে প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে সে বাদকুল্লার দিকে গেছে।
যাই হোক, এই অঞ্জনার অপরূপ শোভা দেখতে হলে দোগাছি গ্রামে যেতেই হবে। কারণ কৃষ্ণনগর শহরের নাগরিক চরিত্রের দাপটে সেখানে অঞ্জনার মৃত্যু হয়েছে। অঞ্জনা কৃষ্ণনগরে নদী থেকে নালায় পরিণত হয়েছে।
লক্ষ্মীপুজোতে সমগ্র দোগাছি গ্রাম উৎসবে মেতে ওঠে। গ্রামের প্রতিটি ঘরে লক্ষ্মী ঠাকুর পূজিত হন। সেই সময় গ্রামের ঘরে ঘরে নাড়ু, মোয়া তৈরি করা হয়। নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, চিনির নাড়ু, গুড়ের নাড়ু— কত যে তার রকমফের! এভাবেই অনেক রকম মোয়াও তৈরি হয়— হাতে ভাজা মুড়ির মোয়া, ঝুড়ি বেসমের মোয়া (‘পক্কান্ন’ বলেও পরিচিত) প্রভৃতি।
বাড়ির পুজোতে আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ থাকে উঠোনে খড়ি মাটি দিয়ে বাড়ির মেয়েদের হাতে আঁকা আলপনা। এটা যেন দোগাছি গ্রামের একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। গ্রামের মেয়েদের হাতে রচিত সেই সব আলপনায় বিশেষ শিল্পবোধেরও পরিচয় পাওয়া যায়। দোগাছি গ্রামের লক্ষ্মীপুজোর বয়স কত সে সম্পর্কে সঠিক সন তারিখ গ্রামবাসীদের কেউ বলতে পারেন না। তবে এই গ্রামের লক্ষ্মীপুজোর অন্যতম আকর্ষণ ভাসান মেলার বয়স যে ৩০ বছর অতিক্রম করেছে, সে বিষয়ে বিশেষ সংশয় নেই। এর আগে পার্শ্ববর্তী ইছাপুর গ্রামে ভাসানের জন্য যাওয়া হত।
দোগাছি গ্রামের লক্ষ্মী প্রতিমাগুলিকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু দোগাছি গ্রামে অনেক পুজো হওয়ায় গ্রামবাসীরা দোগাছি হাইস্কুলের মাঠেই লক্ষ্মীপুজোর ভাসান মেলা বা আড়ং মেলা শুরু করেন। সেই থেকে ফিবছর এই মেলা হয়ে আসছে।
শুধু করোনা অতিমারির জন্য বিগত দুই বছর অর্থাৎ ২০২০, ২০২১ সালে মেলা বন্ধ ছিল। প্রশাসন থেকে মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। পুজো যদিও হয়েছিল ছোট করে। ২০২২ সালে লক্ষ্মীপুজোর সময় কোভিড বিধি-নিষেধের বাড়াবাড়ি না থাকায় প্রশাসন থেকে ভাসান মেলার অনুমতি দেওয়া হয়। এই মেলা মূলত তিন দিনের। লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে মেলা শুরু হয়। তবে মেলার উন্মাদনা চরম পর্যায়ে পৌঁছয় পুজোর আড়াই দিনের মাথায় যখন গ্রামের লক্ষ্মী প্রতিমাগুলিকে ভাসান মেলার মাঠে আনা হয়। সেই দিন সারারাত ধরে চলে মেলা। লক্ষ্মী প্রতিমাগুলি সারিবদ্ধ করে মাঠের ফাঁকা জায়গায় রাখা হয়। ভাসান মেলা কমিটির পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ পুজোগুলিকে পুরস্কৃত করা হয়। তারপর সকালে অঞ্জনা নদীতে লক্ষ্মী প্রতিমাগুলি বিসর্জন দেওয়া হয়। এইভাবে সারারাত কাটিয়ে সকাল পর্যন্ত লক্ষ্মীপুজোর ভাসান মেলা ঘিরে মানুষের উৎসাহ উন্মাদনা থাকে। এরপরেও ভাঙ্গা মেলা আরো দুই-তিন দিন চলে।
লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া।
No comments:
Post a Comment