মুক্তধারার ৪৩তম আলোচনাসত্রে বিজ্ঞানের মেজাজ
দীপাঞ্জন দে: নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরে সম্প্রতি বিজ্ঞানের মেজাজ নিয়ে এক অনবদ্য আলোচনাসত্রের আয়োজন করা হয়েছিল। এই আলোচনাসত্রের আয়োজন করেছিল কৃষ্ণনগরের সাংস্কৃতিক সংস্থা ‘মুক্তধারা’। মুক্তধারার সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের আলোচনাসত্রের আয়োজন করে থাকেন। এটি ছিল তাদের ৪৩তম আলোচনাসত্র। শহরের প্রাণকেন্দ্রে ধারাবাহিকভাবে এই ধরনের আলোচনাসত্রের আয়োজন ইতিমধ্যে বহু মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। শহর তো বটেই, বহু দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষেরা ছুটে আসেন মুক্তধারার আলোচনা শুনতে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি, মুক্তধারার আলোচনা শুনতে আগ্রহী বহু মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন একই ছাদের তলায়। তবে এবারের আলোচনাসত্রের বিষয়টি ছিল একটু ব্যতিক্রমী। এই প্রথম মুক্তধারা বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনাসত্রের আয়োজন করেছিল। তাও আবার ‘বিজ্ঞানের মেজাজ’— হ্যাঁ, মুক্তধারার এবারের আলোচনাসত্রে বিজ্ঞানের মেজাজ বুঝে নেওয়ারই এক প্রয়াস দেখা গেল। আর মুক্তধারার সান্ধ্যকালীন আলোচনাসভায় বিজ্ঞানের এই মেজাজ উপস্থাপনার দায়িত্ব বর্তেছিল আলোচক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়ের কাঁধে।
১৩ নভেম্বর ২০২২ (রবিবার) কৃষ্ণনগর পৌরসভার দ্বিজেন্দ্র মঞ্চে বসেছিল মুক্তধারার ৪৩তম আলোচনাসত্র। মুক্তধারার পক্ষ থেকে প্রতি এক-দেড় মাস অন্তর এই ধরনের আলোচনাসত্রের আয়োজন করা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশতবর্ষের সময় থেকেই মুক্তধারার পথচলা শুরু হয়েছিল। আলোচনা সভা থেকে শুরু করে পত্রিকা প্রকাশ, সংগীতানুষ্ঠান, রবীন্দ্র মেলা— এই ধরনের বহুবিধ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে মুক্তধারা একীভূত হয়ে যায়। তারপর ২০১৫ সাল নাগাদ শুরু হয় নির্দিষ্ট বিষয়কেন্দ্রিক এই ধরনের আলোচনাসত্র। ক্রমান্বয়ে পথ চলতে চলতে ২০২২ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হল তাদের ৪৩তম আলোচনাসত্র। তাদের ৪২তম আলোচনাসত্রটি হয়েছিল ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০২২। বিষয় ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ভাষাচর্চা। আলোচক ছিলেন ড. দেবাশিস ভৌমিক। সেদিনও আলোচনা শুনতে বহু মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। আসলে মুক্তধারার নিয়মিত যে সকল শ্রোতা-দর্শকেরা রয়েছেন, তারা বিশেষভাবে এই আলোচনাসত্রগুলি শোনার অপেক্ষায় থাকেন। ৪৩তম আলোচনাসত্রেও সেটিই হয়। বাড়তি পাওনা ছিল এদিনের আলোচনাসত্রে অধ্যাপক ড. সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনা শুনতে অনেক শিক্ষার্থী, গবেষকেরাও সভাগৃহে উপস্থিত হয়েছিলেন।
বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনাসত্র করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মুক্তধারার পক্ষ থেকে আলোচক হিসেবে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বিষয় স্থির হয় ‘বিজ্ঞানের মেজাজ নিয়ে দু-চার কথা’। পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞান আন্দোলনের ইতিহাস নিয়েই ড. চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণা। এ বিষয়ে তাঁর একাধিক লেখা বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘বিজ্ঞান যখন আন্দোলন: ইতিহাসের পথ বেয়ে’ বইটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার, অজয় হোম স্মৃতি পুরস্কার, বসুন্ধরা সম্মান দ্বারা ভূষিত হয়েছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই আয়োজকেরা বিজ্ঞান বিষয়ক তাদের প্রথম আলোচনাসত্রের জন্য ড. চট্টোপাধ্যায়কেই আমন্ত্রণ জানান। উল্লেখ্য, মুক্তধারার এবারের আলোচনাসত্রের প্রস্তুতি পর্যায়ে বিজ্ঞানের মেজাজ বিষয়ে মানুষের কৌতূহলের বিষয়টি বিশেষভাবে উপলব্ধি করা যায়। আলোচনা শুনতে বহু মানুষ এসেও ছিলেন।
মুক্তধারার আলোচনাসত্রের সূচনায় একটি উদ্বোধন সংগীত পরিবেশন হল প্রচলিত রীতি। এদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি, আলোচনার শুরুতে একটি উদ্বোধন সংগীত পরিবেশিত হয়। বক্তব্যের বিষয়ের সাথে সাজুজ্য রেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতালি’ কাব্যগ্রন্থ থেকে “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে।। আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ে প্রদীপ করো- নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে।।”— এই গানটি উদ্বোধন সংগীতের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। সংগীতশিল্পী শ্রীমতি নূপুর বসুর কন্ঠে এদিন সভামঞ্চে উদ্বোধন সংগীতটি পরিবেশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুল গ্রামে কৃষি-বিজ্ঞান বিষয়ক কাজে গিয়েছিলেন সপরিবারে। সেখানে অবস্থানকালেই ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ আগস্ট তিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। মুক্তধারার ৪৩তম আলোচনাসত্রের আয়োজকদের পক্ষ থেকে আহ্বায়ক সম্পদনারায়ণ ধর, তপনকুমার ভট্টাচার্য ও দীপাঞ্জন দে তাদের সকল দর্শক-শ্রোতাদের ধন্যবাদ জানান। এ দিনের আলোচনাসত্র সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন দীপাঞ্জন দে। উদ্বোধন সংগীত শেষ হলে তিনি মূল আলোচক ড. সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়কে আলোচনা শুরু করার জন্য অনুরোধ করেন।
মুক্তধারার ৪৩তম আলোচনাসত্রে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতা বন্ধুরা এদিন বিজ্ঞানের মেজাজ সম্পর্কে এক মনোজ্ঞ আলোচনার সাক্ষী থাকেন। ড. সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়ের সুন্দর প্রেজেন্টেশনের মধ্যে দিয়ে বিজ্ঞানের মেজাজ ধরতে চাওয়ার প্রয়াস সকলকে আকৃষ্ট করে। শুরুতে কিছুটা প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা গেলেও, আলোচনা শুরু হওয়ার পর কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। সুন্দর একটি আলোচনাসত্র সকলে উপভোগ করেন। মুক্তধারার বিগত আলোচনাসত্রগুলির ন্যায় এদিনও জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি পড়শি জেলার মানুষজনও মুক্তধারার আলোচনা শুনতে এসেছিলেন। আলোচক ড. সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় এদিন তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই আলোচনাসত্রের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। আলোচনার শিরোনাম হিসেবে ‘বিজ্ঞানের মেজাজ’ কথাটি তিনি কেন ব্যবহার করেছেন সে কথাটিও তিনি ব্যাখ্যা করেন।
ড. চট্টোপাধ্যায় স্পষ্টভাবে বলেন যে, “বিজ্ঞানকে আমরা কাজে লাগাচ্ছি, বিজ্ঞানের ব্যবহার করছি। কিন্তু বিজ্ঞানের মূল সূত্র অর্থাৎ পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্তের পর্যায়গুলিকে নির্বাসনে ফেলেই আমরা এগিয়ে চলেছি। আমাদের কিন্তু এতে সমস্যা হচ্ছে না। তবে বিজ্ঞানের মেজাজও তৈরি হচ্ছে না।” এদিন তিনি চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কুসংস্কার থেকে শুরু করে কেরালার মতো রাজ্যে নরবলির কথা— অনেক কিছু সম্পর্কেই বলেন। একাধিক উদাহরণ সহযোগে আলোচক দেখাতে চান যে— বিজ্ঞানের মেজাজের অস্তিত্ব কখনো ছিল না, বা সেই মেজাজ তৈরির প্রয়াস আগে কখনো নেওয়া হয়নি, এমনটা নয়। উনিশ শতকে অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিতদের রচনায় বিজ্ঞানের মেজাজ খুঁজে পাওয়া যায়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক থাকাকালে অক্ষয়কুমার দত্তের সাহসী যুক্তিশীল সমীকরণ উপস্থাপনের কথাও বক্তা উল্লেখ করেন, যেখানে তিনি পরিশ্রমকে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রার্থনাকে শূন্যস্বরূপ হিসেবে দেখতে দ্বিধা করেননি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও সীতার বনবাস রচনায় এরূপ প্রয়াস নিয়েছেন, যেখানে তিনি সীতার পাতাল প্রবেশের মতো অযৌক্তিক বিষয় লেখা থেকে বিরত থেকেছেন। আবার অতিমারিকালে আবির্ভূত হওয়া করোনাশুর বা ভাবিজি পাঁপড়ের মতো বিজ্ঞানের মেজাজ বিরোধী কুসংস্কারের কথাও তিনি আলোচনায় তুলে ধরেন।
বিজ্ঞানের মেজাজ তৈরিতে অক্ষয়কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে রাধানাথ শিকদার, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এমনকি পরশুরাম, সত্যজিৎ রায়ের মতো ব্যক্তিদের যথাসাধ্য প্রয়াসের কথা আলোচক স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপিত করেন। আলোচনাসত্রের দিন দুপুরে কৃষ্ণনগরে তাঁর এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথাও তিনি সভাকক্ষের সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন। মুক্তধারার শ্রোতা-দর্শকেরা এদিন প্রায় এক ঘন্টা দশ মিনিট মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিজ্ঞানের মেজাজ বুঝতে চেষ্টা করেন। শ্রোতা-দর্শকেরা মন দিয়ে মুক্তধারার আলোচনাসত্রটি উপভোগ করায় আয়োজকরাও খুশি। আয়োজকদের পক্ষ থেকে মুক্তধারার অন্যতম আহ্বায়ক সম্পদনারায়ণ ধর মুক্তধারার আলোচনাসত্র সম্পর্কে বলেন, “মুক্তধারার আলোচনা দর্শক-শ্রোতাদের ভালো লাগছে জেনে আমরা খুবই আনন্দিত। যাদের জন্য এই আয়োজন তারা যখন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, তখন আলোচনাসত্রের আয়োজক হিসেবে আমাদের মনে হচ্ছে দায়িত্ব যেন আরো বেড়ে গেল। আশা করছি আগামী দিনেও আমরা এভাবেই আলোচনাসত্র এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো এবং আমাদের দর্শক-শ্রোতাবন্ধুদেরও পাশে পাবো।”
No comments:
Post a Comment